বিশেষ প্রতিবেদন,  ভিওসি

কলকাতা : বাংলার বিধান-২০২১ নির্বচনের জন্য এই রাজ্যের মানু্য অপেক্ষা করে রয়েছে, ভোট দিতে যাবেন এবং কাউকে নির্বচিত করবেন, যারা মানুষের জন্য কাজ করবেন, সভ্য স্বাধীন দেশের মানুষের এটাই প্রত্যাশা।

এর আগে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা বা অন্য যে কোন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করতে পারেনি প্রশাসন। প্রতিটি নির্বাচনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক গোলযোগ, বুথ দখল, ব্যাপক রক্তপাত ও খুন-খারাবির মধ্যেই দেখতে হয়েছে রাজ্যবসীকে। এমনকি নিার্বচন বা নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেো মানু্যের মনে এক ধরণের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। তবে একুশে-র বিধানসভা নির্বচনী তফসিল ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই এ রাজ্যে নির্বাচন কমিশন যে পরিমান কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে তাতে রাজ্যবাসী কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রকাশ করছে।

কিন্ত নির্বাচন কমিশনের কড়া সতর্ক অবস্থানের মাঝেও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে নির্বচনী প্রচারণা নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে ব্যাপক গোলযোগ অব্যাহত রয়েছে, বিশেষ করে আজও বিভিন্ন জনপদে ব্যাপক গন্ডগোল ও মারামারির  খবর পাওয়া গেছে। তবুও নির্বচন কমিশনের উপর ভরসা রাখছে রাজ্যবাসী।

এবার বিধানসভা নির্বচন অবাধ ও সুষ্ঠভাবে করার জন্য নির্বাচন কমিশন অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে,  বিশে্য করে এবার তাঁরা আটদফায় ভোট করবে রাজ্যব্যাপি। নিরাপত্তার জন্য রাজ্য পুলিশকে রাখা হবেনা, কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমান কেন্দ্রিয় বাহিনী মোতায়েন থাকবে ভোট কেন্দ্রগুলোতে। নির্বচন কমিশন কেন্দ্রীয় বাহিনীকে গোলযোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।। এত সব ব্যাবস্থা থাকা সত্বেও বামদলের নেতৃত্বাধীন ‘সংযুক্তমোর্চা’ নিশ্চিত হতে পারছেনা কি হবে আদৌ?

কেননা ২০১৯-র সংসদ নির্বচনে তাঁরা বুঝতে পারেন, একুশে  বঙ্গে ভোটের  লড়াই  হবে  তৃণমূল বনাম বিজেপির মধ্যে।  বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসকে ঐ দু’টি দলের বিরুদ্ধে  শুধু অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই লড়াই  করতে হবে।  মাঝের এই দু-বছর তাদের এমন কিছু পরিবর্তন হয়নি  যে একুশের নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসদল ক্ষমতা দখলের জন্য শক্তি দেখাতে পারবে। তবুও তাঁদের লড়তে হবে আদর্শ রক্ষার জন্য।

এরই মাঝে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বাম-কংগ্রেস ও আই এস এ্ফ-র (ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট) সমন্বয়ে ‘সংযুক্ত মোর্চা’ গঠিত হয়। রাজ্যের বর্তমান  রাজনৈতিক  পরিস্থিতিতে  রাজনৈতিক মহলের প্রশ্ন একটাই,  আইএসএফের  সাথে  জোট করে  বাম ও কংগ্রেস  তাঁদের  হারানো  জমি  কি আদৌ ফিরাতে পারবে?  জোট আসলেই কি তৃতীয় শক্তি হয়ে লড়াই করতে পারবে? এই সব প্রশ্নের জবাব ‘সংয়ুক্তমোর্চা’-র নেতারা্-ই দিতে পারবেন। তবে এবারের ভোটে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ-র সমন্বয়ে  তৃতীয় শক্তি হিসেবে মোর্চা গঠন হয়েছে। তারপর থেকেই শুরু হয় নানান জল্পনার,  বাংলার  রাজনীতিতে এই মোর্চা কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, তাঁরা আসলেই কি ‘কিং-মেকার’ হয়ে উঠতে পারবে?

২০১৬-র  বিধানসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেস  প্রধান বিরোধী দল হিসেবে  ছিল । ২০১৯-এর ভোটে  তাঁরা পিছনের  সারিতে চলে যায়।  কিন্তু একুশের ভোটে আব্বাস সিদ্দিকির আইএসএফের সঙ্গে জোটবেধে প্রাসঙ্গিকতা ফেরাতে চাইছে বামেরা। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ সমন্বয়ের  সংযুক্ত মোর্চা আসন্ন  নির্বাচনে কতটা প্রভাব  বিস্তার করতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

এই আত্মবিশ্বাসের উপর ভিত্তিকরেই বাম-কংগ্রেস নেতারা মনে করছেন  ‘সংযুক্ত মোর্চা’  ব্যালটের মাধ্যমে নিশ্চিত হারানো  জমি পুনরুদ্ধার করতে পারবে।  এই জন্য তাঁরা জনগণের কাছে বিজেপি সরকার ও রাজ্যের তৃণমূল  সরকারের  বিরুদ্ধে দশবছরের ভূল সিদ্ধান্ত, দূর্নীতি, সীমাহীন বঞ্চনা ও নানাবিধ ব্যর্থতার কথা প্রচারণার মাধ্যমে তুলে ধরবে।

 

ভোটব্যাঙ্ক  হিসেবে একটা সময়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন ছিল বাম ও কংগ্রেসের দিকে।  ২০১১ সালের আগেই সেই সমর্থন ঘুরে যায় তৃণমূলের পক্ষে। এখন ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা  আব্বাস  সিদ্দিকির নতুন দলকে সাথে নিয়ে রাজনীতিতে  বাম-কংগ্রেস নেতারা তাদের হারানো ভোটব্যাঙ্ক ফিরানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে এক যোগে কাজ করবে, এমনটি-ই বলেছেন সিপিআইএম-র অন্যতম নেতা কমরেড মোহাম্নদ সেলিম।

২০১৯-ই  জানিয়ে দিয়েছিল একুশে বাংলার ভোটের লড়াই হবে  মূলত: তৃণমূল বনাম বিজেপির মধ্যে। এরমাঝেই বাম-কংগ্রেসকে সেই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে। তারপর  বামেদের জন্য এই দু-বছরে  আহামরি কিছু পরিবর্তন হয়নি,  ফলে একুশের ভোটে বাম-কংগ্রেসজোট  ক্ষমতা দখলের জন্য যে লড়াই  করবেনা এটা নিশ্চিত তাদের ভাবনায় রয়েছে ।

মাত্র  দু’মাস হলো ফুরফুরা পীশরীফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ  ঘটে। শতভাগ ধর্মনিরপেক্ষ দাবীদার এই ফ্রন্টের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় দলের প্রধান আব্বাস সিদ্দিকি বেশ আত্মপ্রত্যয়ি হয়ে ওঠে। তার এই আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার আরও একটি কারণ হলো সাম্প্রতিক ব্রিগেডে সংযুক্তমোর্চার সমাবেশে ব্যাপক লোক সমাগম। আব্বাস মনে করেন, সেই ব্রিগেড সমাবেশে যদি ৬০ শতাংশ জায়গায় বামেদের লাল পতাকা শোভা পেতে দেখা যায়, তবে ৪০ শতাংশে দেখা গিয়েছে আইএসএফ-এর নীল-সাদা-সবুজ পতাকা। আব্বাস সিদ্দিকির বেশিরভাগ  সমর্থক ছিল ১৮ থেকে ২৭ বছরের যুবক। ব্রিগেড সমাবেশে আইএসএ্ফ সমর্থকদের পতাকাবাহি উপস্থিতি আব্বাসকে আরও বেশী উৎসাহী করে তোলে ।

দলের আত্মপ্রকাশ করতে গিয়ে আব্বাস সিদ্দিকী বলেছিলেন, ভোটের সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিগত দশ বছর আমাদের শরীফ এলাকায় উন্নয়নের একটি প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন করেনি মমতা ব্যানার্জী। উপরন্তু, ‘আমাদের উপর গুন্ডা, মাস্তন লেলিয়ে, ভয় ভীতি ও নির্যতন  করানো হয়েছে, আমাদের কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢ়ুকানো হয়েছে। তাই  মমতা ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করার জন্যই আমি এই ফ্রন্ট গঠন করেছি’।

আব্বাস সিদ্দিকি বলেছেন, তৃণমুল  রাজ্যের সংখ্যালঘু  ৩০ ভাগ ভোট  তাদের নিজেদের সম্পদ বলেই মনে করে, কিন্তু এবার এই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক’ তাদের জন্য বিশাল ফ্যাক্টর হয়ে উঠবে নিশ্চিত।  বঙ্গে সংখ্যালঘু অধ্যূষিত প্রায় ১০০টি আসন রয়েছে।এই আসনগুলোতে মমতার কোন ‘অ্যাডভোকেসী’-ই এবার কাজে আসবেনা, বলেছেন আব্বাস সিদ্দিকি।

রাজনৈতিকভাবে জোট করতে গিয়ে আব্বাসের সাথে বামম্ফ্রন্টের অর্থবহ সমঝোতা হলেও কংগ্রেসের সাথে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্রসঙ্গত, আব্বাস সিদ্দিকীর দাবি অনুযায়ী বামেরা তাদের কোটা থেকে আব্বাসের দলকে ৩০টি আসন ছেড়ে দিতে সম্মত হলেও কংগ্রেসের সঙ্গে আইএসএফ-এর আসন বরাদ্দ নিয়ে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়।। সূত্রের খবর, মালদা, মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ দিনাজপুরের মত কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলি আব্বাস সিদ্দিকি তার ফ্রন্টকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু, কংগ্রেসের পক্ষে অধীররঞ্জন চৌধুরী উক্ত আসনগুলো আইএসএফ-কে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব বলে জানিয়ে দেয়।

পরবর্তীতে বামফ্রন্টের বর্ষীয়াননেতা বিমানবসুর মধ্যস্থতায় ব্যাপারটির সমাধান হয়। এ প্রসঙ্গে বিমানবসু বলেন, ”এই নির্বাচনে বিজেপি এবং তৃণমূল একদিকে, আমরা সবাই মিলে অপর পক্ষে ”। তিনি বলেন, তৃণমূল বিজেপির মত ধোঁকা দেয়া প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতা ভেঙ্গেঁ সংযুক্তমোর্চা রাজ্যের মানুষের জন্য বাস্তব রূপায়ন যোগ্য শক্তি হিসেবে কাজ করবে।

সংযুক্তামোর্চ গঠন সম্পর্কে সিপিআইএম সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, আমরা ‘সংযুক্তমোর্চা’ গঠন করেছি একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। নিপীড়িত শ্রেনী, সামাজিক অংশের মুক্তির লক্ষ্যেই আমাদের এই মেলবন্ধন। এ রাজ্যে সংযুক্ত মোর্চাকে কেবল নির্বচনী সংগ্রামের মধ্যে সীমিত না রেখে মানুষের জীবন-জীবিকা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ওপর আক্রমন মোকাবেলায় সুদূরপ্রসারী হাতিয়ার হিসেবে দেখতে হবে।

জোটে আব্বাস সিদ্দিকি-র দলকে যুক্ত করা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যে সমালোচনার সৃষ্টি  হয়েছে, এমন কি ভোটে জেতার জন্য বামপন্থীরা মৌলবাদি সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছে, এই সমস্ত প্রশ্নের জবাবে  সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, আইএসএফ কোনও সাম্প্রদায়িক শক্তি নয়, অন্যান্য মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর চেয়ে ভিন্ন। তাদের ঘোষণাপত্রে আদিবাসী, তপশিলী জাতি, মতুয়া সম্প্রদায়, অন্যান্য অনগ্রসর অংশ, সংখ্যালঘু এবং বর্ণহিন্দুসহ সবার কথাই বলা রয়েছে। যে সব দল  অসাম্প্রদায়িকতাকে মান্যতা দেবে তাদের সাথে বামফ্রন্ট কাজ করতে রাজী থাকবো । তিনি বলেন, ভরতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমদের শিক্ষা দিয়েছে মানুষের ঐক্য ছাড়া সংগ্রামে জেতা সম্ভব নয়। শ্রেণী ও সামাজিক বৈষম্যর স্বীকার সবঅংশের মানুষেকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আইএসএফ-র সাথে আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি।

প্রার্থী তালিকা

সিপিআইএম আগেই প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেছ, কংগ্রেসও প্রায় সম্পন্ন করেছে।উত্তরবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা বাকি রেখে আইএসএফ প্রধান আব্বাস সিদ্দিকি আজ তাদের দলের ২০ জনের নাম ঘোষণা করেছেন।

এবার সংযুক্তমোর্চার প্রার্থীতালিকায় বেশীরভাগ নতুন প্রজন্ম ও কমবয়সী মেধা, শিক্ষিত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে বলে জোট নেতারা জানিয়েছেন।