নিজস্ব প্রতিনিধি 

পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতা কিছুতেই কমছেনা। এবার বিরভূম জেলার রামপুর হাটের বগটুই গ্রামে তৃণমূলের  পঞ্চায়েত  উপপ্রধানের খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। রামপুরহাটের ওই গণ হত্যা কাণ্ডের পর  তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি।  রামপুর হাটের খুনের অভিযোগ ঘিরে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে বীরভূমের রামপুরহাট।

সোমবার রাত সাড়ে আটটার দিকে  রামপুরহাটের বাইপাস লাগোয়া জাতীয় সড়কের  বগটুই  মোড়ের একটি  চায়ের দোকানে বসে  রামপুরহাট-১ ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ চা খাচ্ছিলেন এই সময়  সেখানেই  দুষ্কৃতীদের অতর্কিত বোমা হামলায় ঘটনাস্থলে  মৃত্যু  হয় তার।  ভাদু শেখের বাড়ি রামপুর হাটের বগটুই গ্রামে। উপপ্রধান  খুনের পর অনুগামীরা  ‘বদলা  নিতে গ্রামের  বাড়িতে বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, রাতভর চলে সেখানে বোমাবাজীর তান্ডব।মঙ্গলবার সেই গ্রাম থেকে অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া বাড়ির মধ্য থেকে সাতজনের অগ্নিদগ্ধ দেহ উদ্ধার করা হয়।  খবর পেয়ে সোমবার রাতেই গ্রামে যান দমকলের আধিকারিকরা। দমকলেরই এক আধিকারিক জানান, সোমবার রাতে তিনজনের দেহ এবং মঙ্গলবার সকালে সাতজনের দেহ উদ্ধার  করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানানো হয়, বগটুই গ্রামের পূর্ব পাড়া ও পশ্চিম পাড়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা রেষারেষির সম্পর্ক রয়েছে। এর আগেও একাধিকবার ওই এলাকায় বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাম্য বিবাদ নাকি রাজনৈতিক দলাদলির জেরে এই ঘটনা সবটাই এখনও তদন্তসাপেক্ষ। তবে ইতিমধ্যেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে সোমবার রাতে তৃণমূলের উপপ্রধানের মৃত্যুর পর থেকেই এলাকায় পুলিশ ছিল। তারপরও কীভাবে এমন ঘটনা ঘটলো। সিপিএম্ রাজ্য সম্পাদক মহাম্নদ সেলিম এই ঘটনাকে গণহত্যা বলে তোপ দাগেন। তিনি পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, সোমবার রাত সাড়ে ৮টায় বগটুই মোড়ে ভাদু শেখের খুনের ঘটনাটি ঘটে। ভাদু শেখের মৃত্যুর পর ঘটনাস্থলে যায় পুলিস। কিন্তু ভাদু শেখের গ্রামে পুলিস যায়নি। ভাদু শেখের খুনের প্রতিক্রিয়ায় তার অনুগামীরা যে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন, তা কেন আঁচ করতে পারেনি পুলিস? কেন কোনও স্ট্র্যাটেজি নেয়নি পুলিস? কেন ওই সময়ের মধ্যে গ্রামের দখল নেয়নি তারা? বগটুই গ্রামের ঘটনায় পুলিসের  ভূমিকা নিয়ে মুহাম্নদ সেলিমের যে প্রশ্ন চিহৃ তার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছে সব বিরোধী দলই।

এ ব্যাপারে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্র জানায়, সেখানে পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় গ্রামে ঢুঁকতে পারেনি পুলিশ। কিন্তু পুলিসের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে স্বরাষ্ট্র দফতরের অন্দরেই। প্রসঙ্গত, ভাদু শেখের খুনের ঘটনায় যাদের নাম অভিযোগে উঠে আসে তাদের বাড়িও এই বগটুই গ্রামে। পাশাপাশি এক বছর আগেই দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সেই বিবাদে তখনও গ্রামে খুন হন ভাদু শেখের দাদাও। তখনও পশ্চিমপাড়ার কয়েকজনের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। এই তথ্যগুলো কি পুলিস জানত না? বা জানা থাকলে তারপরেও বগটুই গ্রামে কেন কোনও দল পাঠায়নি পুলিস? গোটা ঘটনায় রামপুরহাট থানা  কর্তৃপক্ষের ‘গাফিলতি’র দিকেই উঠছে অভিযোগের আঙুল। এই ঘটনায় মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিসের ডিজি মনোজ মালব্য। যদি দমকল বাহিনী সূত্র বরাবর ১০ জনের মৃত্যুর কথাই জানিয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে ফের এ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধী শিবিরও। এলাকাবসীর অভিমত, এই বিদ্বেষের সূত্রপাত শুরু হয় মূলত: পুরসভা নির্বাচনের পর থেকেই, তাই এই ঘটনার সাথে শাসকদলের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিষয়টিও পরিস্খার বলেও তারা মনে করছেন।।ঘটনার তদন্তে রাজ্য সরকার এডিজি (সিআইডি) জ্ঞানবন্ত সিংয়ের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট তৈরি করেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, নিহত বরশাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখ গত পুরসভা নির্বাচনে রামপুরহাট পুরসভা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। দলেরই একটি গোষ্ঠীর হয়ে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যার জন্য অপর একটি গোষ্ঠীর চক্ষুশূল হন। পরবর্তী সময়ে যত দিন যেতে থাকে ততই এই বিদ্বেষ বাড়তে থাকে বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের মনে প্রশ্ন জেগেছে সেই বিদ্বেষের সঙ্গে ভাদু শেখের খুনের কোনও সম্পর্ক আছে কি নেই। যে সমস্ত বাড়িগুলিতে আগুন লাগানো হয়েছে তারা ভাদু শেখের আত্মীয় এবং এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী বলে পরিচিত হলেও রাজনৈতিকভাবে দলে ভাদুর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। যদিও ভাদু খুনের বদলা নিতেই পাল্টা অগ্নিসংযোগ কি না সেবিষয়ে পুলিশ সরকারিভাবে এখনও কিছু জানায়নি।মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে যান রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল-সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এডিজি (পশ্চিমাঞ্চল) সঞ্জয় সিং-সহ অন্যান্য পুলিশ কর্তারাও গেছেন ঘটনাস্থলে। রাজ্য সরকারকে বদনাম করতেই এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ফিরহাদ। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, তদন্ত চলছে। ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড়া হবে না।এদিকে এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তৃনমুলের রাজ্য সম্পাদক কুনাল ঘোষ মঙ্গলবার সকালে টুইট কর বলেছিলেন, স্থানীয় গ্রাম্য বিবাদের জেরেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এই আগুনের  সঙ্গে রাজনীতির  কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু দুপুরেই তিন সেই বক্তব্য পাল্টিয়ে  তিনি বলেন এই ঘটনায় রাজনৈতিক যোগ রয়েছ।রামপুরহাটের এই নৃশংস ঘটনায় রাজ্য পুলিশের  ডিজি রিপোর্ট তলব করল নবান্ন। ঘটনার খবর পেয়েই তড়িঘড়ি বৈঠকে বসেন মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি ও এডিজি আইন-শৃঙ্খলা। তারপরই পুলিস সুপারের  কাছে  ঘটনার  বিস্তারিত রিপোর্ট  তলব করেছেন মুখ্য সচিব। এদিকে জরুরীভিত্তিতে রাজ্য মুখ্যসচিবের কাছে এই ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল জগদিপ ধনখড়। রামপুরহাটের ঘটনার প্রতিবাদে সকালে  বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করেছে বিজেপি।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ৭২ ঘন্টার মধ্যে এই নৃশংস ঘটনার বিস্তারিত রিপোর্ট চেযেছেন। রিপোর্ট পাওয়ার স্বরাষঋ্র মন্ত্রক অতিরিক্ত সচিবকে পাঠাবেন সরেজমিনে দেখার জন্য।