নিজস্ব প্রতিবেন
বীরভূমের রামপুরহাটের বগটুইয়ের ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই বাংলার শাসকদল তৃণমূলকে একযোগে আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। তাদের দাবি, শাসকদলের গোষ্ঠী কোন্দলের কারণেই বীরভূমের বগটুই গ্রামে ১০ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। বগটুই হত্যাকান্ড নিয়ে এখন সরগরম রাজ্য রাজনীতি। বিজেপি বিধায়কদের থেকে শুরু করে বাম নেতারা সবাই ছুটছেন বগটুইয়ে। দিল্লি থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলও পাঠাচ্ছেন জে পি নাড্ডা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করে দিয়েছেন, তিনি আজ (বৃহস্পতিবার) ঘটনাস্থল বগটুই যাবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে ইতিমধ্যেই রামপুরহাটের হত্যাকান্ড নিয়ে রাজ্যের রিপোর্ট তলব করা হয়েছে।রামপুরহাটের বগটুই ‘হত্যাকান্ড’ নিয়ে ইতিমধ্যেই তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। এই ঘটনা নিয়ে শাসক দলের বিরুদ্ধে দফায় দফায় সুর চড়িয়েছেন বিরোধী নেতারা। লোকসভাতেও এই ঘটনার আঁচ পড়ল। বুধবার লোকসভায় বগটুই হত্যাকান্ড প্রসঙ্গ তুললেন বিজেপি সাংসদ এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি ড. সুকান্ত মজুমদার। তিনি লোকসভায় এই ঘটনার সম্পূর্ণ বর্ণনা দেন। তারপর তিনি লোকসভায় সকল দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন যে গত এক সপ্তাহে বাংলায় ২৬ টি রাজনৈতিক খুন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্রমান্বয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবি জানান সংসদে।
তিনি স্পষ্টভাবে জানান, সোমবার তৃণমূল চালিত পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখের খুন হন। সেই খুনের বদলা নেওয়ার জন্যই সেই রাতে পাঁচটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। শুধু তাই নয় সেই ঘর থেকে যাতে কেউ বেরিয়ে আসতে না পারে তার জন্য বাইরে দরজায় তালাও দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এই গোটা ঘটনায় প্রায় ১২ জন মারা গিয়েছে। মৃতদের মধ্যে রয়েছে শিশুরাও। তিনি সংসদে বলেছেন যে, মৃতরা সবাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তিনি বলেছেন, “শুধু ১২ জনই মৃত নয়। গ্রামবাসীরা দাবি করেছেন যে প্রায় ২০ জন নিখোঁজ। গ্রামবাসী বলেছেন যে পুলিশের চোখের সামনে গোটা ঘটনা ঘটেছে।” তিনি এদিন সংসদে সমগ্র বাংলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন লোকসভায়। এই অবস্থায় তিনি কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপেরও দাবি জানান।
এবার এই ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করবেন তৃণমূল সাংসদদের একটি প্রতিনিধি দল। ইতিমধ্যে দলের তরফে তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কাছে সময় চেয়েছেন। জানা গিয়েছে, যে কোনও মুহূর্তে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হতে পারে তৃণমূল সাংসদের।বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে ক্রমাগত দাবি করা হচ্ছে, দলীয় কোন্দলের ফলেই ১০ জনকে বোমা মেরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমনকী রাজ্য প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ সেই দাবিও করা হয়েছে। সূত্রের খবর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এই জাতীয় যাবতীয় অভিযোগ খণ্ডন করবেন পতিনিধি দলের সদস্যরা। তৃণমূল সাংসদরা সম্ভবত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন, এই মর্মান্তিক ঘটনার পিছনে কোনও দলীয় গোষ্ঠী কোন্দল নেই। পারিবারিক কারণেই বীরভূমে এই হত্যালীলা চলেছে। ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় রাজ্য সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছেন, এবং সিট গঠন করা হয়েছে এই তথ্যও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরতে পারেন তৃণমূল সাংসদরা। দোষীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেই কথাও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হবে।
রামপুরহাট হত্যাকান্ড নিয়ে এবার আরও চাপ বাড়ছে রাজ্য সরকারের উপর। জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রাজ্য পুলিশের ডিজিকে চিঠি লিখে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট চেয়েছে জাতীয় মহিলা কমিশন। । বীরভূমের পুলিশ সুপারকেও ওই চিঠির কপি দেয়া হয়েছে।। রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে সোমবার রাতে যেভাবে একের পর এক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে, তাতে যেভাবে মহিলা ও শিশুদের প্রাণহানি হয়েছে, রীতিমতো উদ্বিগ্ন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ফের একবার প্রশ্ন উঠেছে। বগটুই কান্ডে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা।
ঘরে আগুন লাগানোর আগে সোনা শেখের বাড়িতে ঢুঁকে বাড়ির লোকজনকে এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। কুপিয়ে খুনের পর দেহে আগুন লাগানো হয়েছিল। বিশেষ তদন্তকারী দল(সিট)-কে মৌখিকভাবে জানাল ফরেনসিক । সূত্রের খবর, ফরেনসিক রিপোর্টে উঠে এসেছে, ঘর রক্তে ভেসে গিয়েছিল। বিভিন্ন ঘরে মিলেছে পোড়া রক্তের নমুনা। একটি লোহার রড থেকে আঙুলের ছাপও নেওয়া হয়েছে বলে খবর। একটি প্লাস্টিকের জার মিলেছে অকুস্থল থেকে। ঘরের দক্ষিণ পূর্ব কোণে প্রথম আগুন লেগেছিল বলেও উঠে এসেছে ফরেন্সিক রিপোর্টে।
বুধবার দুপুরেই স্টেট ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবের বিশেষজ্ঞরা মৌখিকভাবে সিটের তদন্তকারী অফিসারদের জানিয়েছেন, যে ঘরে দেহ পাওয়া গিয়েছিল, দেখা গেছে দেহের মাথায় ও শরীরের একাধিক জায়গায় আঘাতে চিহ্ন রয়েছে। ঘরের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় পোড়া রক্তের দাগ পেয়েছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা। ফরেনসিকের বায়োলজিক্যাল এক্সপার্ট যিনি এসেছিলেন, তিনি ইতিমধ্যেই সেই নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
এর মধ্যে সবথেকে বড় যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হল সরাসরি আগুন দেওয়া হয়নি মৃতদের গায়ে। যেভাবে একটি জায়গাতেই সব দেহগুলি পাওয়া গিয়েছিল, তা থেকে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি গায়ে সরাসরি আগুন দিয়ে দেওয়া হত, তাহলে তাঁরা ছটফট করতেন এবং দেহের অংশ বিশেষ ঘরের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যেত। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা বা ছটফট করার চেষ্টার চিহ্ন দেখা যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘরের একটি নির্দিষ্ট জায়গাতেই দেহের বিভিন্ন অংশ পাওয়া গিয়েছে। তাই আগে তাদের হত্যা করে পরে তাদের গায়ে আগুন ঢেলে দেয় হয়েছে, এমনটাই প্রাথমিক ধারণা ফরেন্সিক এক্সপার্টদের। এদিকে রামপুরহাটের বগটুই-কাণ্ডে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাজ্যকে প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।