কিশোরসরকার
ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে থেকেই ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দলগুলির নেতাদের সঙ্গে বিশেষ সখ্যতা ছিল। তাই পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের পর থেকে বাঙালি জাতিকে ‘ভারত বিরোধী জাতি’ হিসেবে তৈরি করতে চাইলেও সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনাকারী জাতীয় নেতাদের সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন কংগ্রেসের তৎকালীন নেতারা। সেই সমস্ত নেতাদের মধ্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতির মতো সাংবিধানিক পদে বসার পরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে ছিলেন। কিন্তু ভারতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সেই সম্পর্ক কিছুটা ব্যাহত হয়। ফলস্বরূপ ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি আমলা নির্ভর হয়ে পড়ে।
২০০১ সালে বিএনপি ও কট্টর পন্থী জামাত জোটকে ক্ষমতায় আনার পরামর্শ ওইআমলাদের কাছ থেকেই হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট যতদিন ক্ষমতায় ছিল সেভেন সিস্টার্সে রক্ত ঝরেছে ভারতীয় সৈনিকদের। ২০০১ সালে নির্বাচনের পরে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের বিএনপি-র অফিসে মিস্টি বিতরণ হয়েছে। তবে পুরানো ফাঁদে আর পা দেয়নি বিজেপি। কিন্তু বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষায় আমলা নির্ভর হওয়ায় বাংলাদেশ-সহ পাশের দেশগুলির রানৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে না ভারতের। দু’দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমলাতন্ত্র। বাংলাদেশে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি-সহ রাজনৈতিক দলের পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তদবির বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে দু’দেশের ভারতীয় আমলাদের বিরুদ্ধে। এমনকি দু’দেশর একটি সিন্ডিকেও রয়েছে। এর ফলে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সরকারের আধিকারিকদের এবং নাগরিকদের মধ্যে। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তান। বিভিন্ন ভাবে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের নাগরিকদের। এই ক্ষেত্রে আমালা নির্ভরতা কমিয়ে রাজনৈতিক দল ও ভারত-বাংলাদেশ ‘পিপল টু পিপল রিলেশন’ বাড়াতে না পারলে, উভয় দেশকেই চরম মূল্য দিতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্টজনরা।
ভারত-বাংলাদেশ পিপল টু পিপল রিলেশনে বাধা এবং এর ক্ষতিকারক বিষয় নিয়ে সাংবাদিক কিশোর সরকারের সঙ্গে মতামত বিনিময় করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, সুফিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী আল-হাসানী আল-মাইজভান্ডারী-র চেয়ারম্যান শাহ্জাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোটের মুখপাত্র পলাশ কান্তি দে।
মত বিনিময় করতে গিয়ে মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমলাদের পরামর্শে ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে বিএনপি-জামাতকে সমর্থন করা বিজেপির ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। যার খেসারত ভারত-সহ বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। আমরা যারা ধর্মীয় মূল্যবোধের রাজনীতি করি তারা মনে করি কেবল সরকারের সঙ্গে নয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক হতে হবে পিপল টু পিপল। অন্যথায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন উভয় দেশের মানুষ। সুযোগ নেবে স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানপন্থীরা। তিনি বলেন, বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির মতো সাংবিধানিক পদে বসেও সেই বন্ধুত্বের হাত গুটিয়ে রাখেননি প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়। নীচু স্তরের বাংলাদেশের একজন নেতা গেলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতেন। তিনি বলেন, বিজেপির সঙ্গে যদি বিগত কংগ্রেস সরকারের ন্যায় সম্পর্ক থাকতো তাহলে ২৬ মার্চের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় আলেম (ইসলামী পন্ডিত) সমাজকে ভুল বুঝিয়ে জামাতে ইসলাম বাংলাদেশে যে তান্ডব চালিয়ে ছিল তা করতে পারতো না। এটা রুখে দেওয়া যেত। তিনি বলেন, আমরা যারা উদারপন্থী ইসলামী দল এবং উদার পন্থী হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সংগঠন আছি দু’দেশের মধ্যে পিপল টু পিপল রিলেশন তৈরির জন্য কাজ করতে চাইছি, তাদেরকেও দূরে সরিয়ে রাখছে ভারতের আমলাতন্ত্র। চিন উইঘুর প্রদেশে মসজিদ ভেঙে টয়লেট বানাচ্ছে, জোর করে মুসলিমদের ধর্মান্তরিত করছে, মুসলিমদের ধরে নিয়ে কিডনি বিক্রি করছে। কিন্তু বাংলাদেশের আলেমদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ হচ্ছে না। কারণ কট্টরপন্থীদের পাশে পাকিস্তান থাকলেও উদারপন্থীদের পাশে ভারত থাকছে না। তিনি আরও বলেন, ভারতের বর্তমান সরকার আমলাদের পরামর্শে শুধু সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির মাধ্যমে নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্কের চেষ্টা না করলে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করবে, য়া কালক্রমে ভারতেও ছড়িয়ে পরবে।
সুফিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী আল-হাসানী আল-মাইজভান্ডারী-এর চেয়ারম্যান শাহ্জাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালে দিল্লিতে বিশ্ব সুফি সম্মেলনে হয়েছিল। সেই সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আমি যোগদান করেছিলাম। ২০২২ সালে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক সুফি ঐক্য সংহতি সমাবেশ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী-সহ বিশ্বের উদারপন্থী ধর্মীয় নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে ধর্মীয় নেতাদের কথা মানুষ বেশি মূল্যয়ন করেন। তাই ভারত-বাংলাদেশ পিপল টু পিপল রিলেশন তৈরির জন্য আলেম (ইসলামিক পন্ডিত), ওলামাদের (ইসলামী প্রচারক) সঙ্গে নেওয়া দরকার।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ভারত-বাংলাদেশ পিপল টু পিপল রিলেশন তৈরির জন্য দু’দেশের মধ্যে সংস্কৃতি, শিক্ষা সফর বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে আরও বেশি করে ভারতকে পরিচয় করাতে হবে ভারতের উদারপন্থি মনোভাবকে বুঝানোর জন্য। জামাত-বিএনপি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করে। ভারতে মুসলিমদের উপরে নির্যাতন চলে, এই ধরনের অপপ্রচার করে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সত্যিটা জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে ভারত সরকারকে।
পিপল টু পিপল সম্পর্ক প্রসঙ্গে পলাশ কান্তি দে বলেন, বাংলাদেশের উদারপন্থী ধর্মীয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বিজেপির যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কারণ বিজেপি মুসলিম বিরোধী বলে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু আসলে মোটেই তা নয় কিন্তু সত্যিটা তো বাংলাদেশের নাগরিকদের জানাতে হবে, এই জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রকৃত সত্যটা তুলে ধরার জন্য ভারতকে বেশী করে অআ্যডভোকেসি করতে হবে।
–লেখক বাংলাদেশের সাংবাদিক