ওমর আলী, ঢাকা থেকে
মুক্তিযুদ্ধকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. কিসিঞ্জিার যদি সমর্থন না দিতো তবে বাংলাদেশে পাক বাহিনী গনহারে মানুষকে হত্যা করার সাহস পেতনা। মুক্তিযুদ্ধে এত মানুষ শহীদ হতোনা। বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের যুদ্ধাপরাধ ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন-ড.কিসিঞ্জারের দায় এর ইংরেজি সংস্করণের প্রকাশনা উৎসবে একথা বলেন বইটির লেখক, বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরুন নবী। শুক্রবার বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে The Role of NIXON-KISSINGER in the 1971 Pakistan War Crimes Against BANGLADESH এর প্রকাশনা উৎসবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি একথা বলেন।
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক ড. নূরুন নবী বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার এ বিষয়ে নীরব ছিলেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের নিন্দা করেনি, তাদের থামানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি, যা তাদের ক্ষমতার মধ্যে ছিল। যদি নিক্সন-কিসিঞ্জার ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ইয়াহিয়া খানকে অন্ধভাবে সমর্থন না করত, তাহলে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ কম হত অথবা হত না। তাই বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের দায় নিক্সন-কিসিঞ্জার এড়াতে পারে না।
প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। বিশেষ অতিথি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। কবি ইউসুফ রেজার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই প্রকাশনা উৎসবে সভাপতি ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন- মুক্তধারা ইউএস এর স্বত্বাধিকারী বিশ্বজিৎ সাহা। খবর: এনআরবি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন- একাত্তরে নিক্সন ও কিসিঞ্জার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে অপপ্রচার করেছিল, ৫০ বছরে বাংলাদেশে তা ব্যর্থ প্রমানিত হয়েছে। বাংলাদেশকে তারা তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিল, বাংলাদেশে এখন প্রয়োজনের চেয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদ আছে এবং উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, একাত্তরে লেখক নিজের চোখে যা দেখেছেন, তা প্রকাশ করেছেন বইয়ে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে অপপ্রচার চালিয়েছেন, তার তথ্যনিষ্ঠ প্রতিবাদ আছে। তিনি বলেন, ইদানীং অনেকে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি হালকা করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম শর্মিলা বোসের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছেন লেখক। নূরুন নবী দেখানোর চেষ্টা করেছেন, নিক্সন-কিসিঞ্জার পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে এ গণহত্যায় সহায়তা না দিলে এত ভয়াবহ গণহত্যা বাংলাদেশে ঘটত না। সে কারণে তিনি গণহত্যার অভিযোগে কিসিঞ্জারের বিচারের দাবি ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি লেখক দেখিয়েছেন, একাত্তরে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সে দেশের সাধারণ মানুষ ও ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত নন এমন অনেক রাজনীতিকের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন ও বলিষ্ঠ বক্তব্য দিয়েছেন। মেরিল্যান্ড বন্দর থেকে একটি জাহাজে করে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি জানতে পেরে সেখানকার সাধারণ মানুষ ছোট ছোট নৌযান নিয়ে জাহাজটি ঘিরে রাখেন ও তাতে অস্ত্র তুলতে বাধা দেন। নানা রকম চাপ ও হুমকি সত্ত্বেও তাঁরা সেখান থেকে সরে যাননি। ফলে সেই জাহাজে অস্ত্র তোলা সম্ভব হয়নি। ইংরেজি ভাষায় বইটি লেখায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হলো বলে মতপ্রকাশ করেন মসিউর রহমান।
সভাপতির বক্তব্যে কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, কিসিঞ্জারেরা বাংলাদেশ সম্পর্কে যে অপপ্রচার চালিয়েছিলেন, নৈতিকভাবে ও বাস্তবতায় তাঁদের পরাজয় ঘটেছে। বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। তিনি মুক্তিযদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে পাকসেনাদের কর্মকান্ড নিয়ে শর্মিলা বসুর লেখার কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গনহত্যা বন্ধ করে স্বীকৃতি দিতে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু তারা তখন ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধ উপেক্ষা করে তাকে ফিরিয়ে দেন। আসাদ চৌধুরী বলেন, ইংরেজি বইতে সাধারনত অনেক ভুল থাকে। এই বইটিতে কোনো ভুল আমার চোখে পড়েনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ বিষয়ে ড. নূরুন নবীর লেখা আরও ১৭ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি তাঁর লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারত’ ও ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের যুদ্ধাপরাধ প্রেসিডেন্ট নিক্সন-কিসিঞ্জারের দায়’ ভারতের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষণার জন্য স্বীকৃতি পেয়েছে। ড. নূরুন নবীর লেখা উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধে ভারত, অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধ, জন্ম ঝড়ের বাংলাদেশ, বাংলাদেশে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধ ও প্রেসিডেন্ট নিক্সন- ড. কিসিঞ্জারের দায়, জাপানিদের চোখে বাঙালি বীর, স্মৃতিময় নিপ্পন, আমার একাত্তর, জন্মেছি এই বাংলায়, আমেরিকায় জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি, শামসুর রাহমান- স্বাধীনতার কবি, অন্তরঙ্গ জানালায় বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু ও বিশ্ববন্ধু, Born in Bangla, Bangabandhu and turbulet Bangladesh, BULLETS of ’71 A freedom Fighter’s Story. বইগুলো একুশে বইমেলা ও কলকাতা বইমেলায় পাওয়া যাবে। মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক পরিচিতি ছাড়াও বিজ্ঞানী হিসেবে ড. নূরুন নবীর খ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কোলগেটসহ প্রায় ১০০টি পণ্যের পেটেন্ট আবিস্কারক।