নিজস্ব প্রতিনিধি

বাংলাদেশে এক শ্রেণীর উগ্র দুষ্কৃতিকারী দূর্গাপূজার মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙ্গচুর, সংখ্যালঘুদের উপর হামলাসহ ইসকন মন্দির যখন বিধ্বস্ত,  তখন  পশ্চিমবাংলার নদীয়ার মায়াপুর  ও মালদার চাঁচলে দেখা গেল  ভিন্ন ছবি। সম্প্রীতির এক  অনন্য নজির স্থাপন  হলো মায়াপুর আর চাঁচলে।

শনিবার ছিল ইসকনে ভক্তদে্র তৈরী পাণ্ডব সেনার শিব মন্দিরের শুভ উদ্বোধন ।এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলিমের বিভাজন ভুলে  অংশ নেয় নদীয়া জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ তারান্নুম সুলতানা মীরসহ আরও আনেকে।মন্দিরের মহা অভিষেকের সময় শিবের মাথায় জল ঢালেন তারান্নুম সুলতানা মীরসহ বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু মানু্ষ।

পরে তারান্নুম বলেন, “মায়াপুরে আমরা সবাই সমস্ত রকম বিভাজনভুলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আদর্শ নিয়ে বসবাস করি। এখানে কখনও বাংলাদেশের মত সম্প্রীতি বিঘ্ন ঘটে না।” একই সুর শোনা গেল ইসকন আধিকারিক অলক গোবিন্দ দাসের কথাতেও। তিনি বলেন, ”বহু বছর ধরে নদীয়া তথা মায়াপুরে আমরা হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে ইসকন মন্দিরে ভক্তি ভরে পূজা উপভোগ করি, প্রসাদ খাই, কিন্তু বুধবার সোস্যাল মিডিয়ায়  একটি গুজবকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যে হিংসার ছবি আমরা দেখেছি তা আমাদের এখানে কখনও ঘটেনি।

এ্কই চিত্র দেখা গেল মালদার চাঁচালেও। উমার বিদায়লগ্নে সম্প্রীতির সুর । দশমীর গোধূলিতে দেবী দুর্গার বিদায়-পর্ব, আর তাতে সামিল হলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন। আলো জ্বালিয়ে বিদায় জানালেন মা-কে। এ ছবি মালদার পাহারপুর মরা মহানন্দার সতীঘাটের। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এই রীতিতে এসেছে সামান্য বদল। আগে লণ্ঠন জ্বালিয়ে সাহুরগাছির বধূরা দাঁড়িয়ে থাকতেন মরা মহানন্দার ওপারে। আর এবার নিরঞ্জনের সময় ওপারের আকবর আলি জ্বালালেন চার্জার লাইট। সম্প্রীতির এই কোলাজেই রব উঠল…আবার এসো মা।

চাঁচলের রাজা রাম চন্দ্র রায় বাহাদুর আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে এই পুজোর শুরু করেছিলেন। রাজবাড়ির পুজো নামে পরিচিত চাঁচলের এই পুজো। বর্তমানে রাজা নেই, নেই তাঁর রাজপাট। কিন্তু রয়ে গিয়েছে রাজ আমলের রীতি। আর সেই রীতি মেনেই দশমীর দিন গোধূলি লগ্নে চাঁচল পাহাড়পুরের চণ্ডী মন্দিরের সামনে ঠিক দুশো মিটার দূরে মহানন্দায় বিসর্জন দেওয়া হল প্রতিমার। আর এই বিসর্জনের সময় নদীর ওপারের বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ লণ্ঠনের আলো জ্বালিয়ে মা-কে বিদায় জানান। কেউবা জ্বালান ফ্লাশ ও চার্জার লাইট।

কথিত রয়েছে, কোনও এক সময়ে চাঁচলের মরা মহানন্দা নদীর তীরবর্তী এলাকার সাহুরগাছি-বিদ্যানন্দপুর গ্রামে মহামারী শুরু হয়েছিল। সেই সময় নাকি পাহাড়পুরের চণ্ডী মন্দিরের দেবী স্বপ্নে তাঁদের বিসর্জনের সময় আলো দেখাতে বলেন। সেই থেকেই ওই এলাকার মানুষেরা আজও মাকে আলো জ্বালিয়ে দশমীর দিন বিদায় জানান।

শুক্রবার সন্ধ্যায় ঠিক গোধূলি লগ্নে মরা মহানন্দার ওই পাড় থেকে দেবী-কে বিদায় জানান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে আস্তে আস্তে সেই হ্যারিকেনের প্রচলন উঠতে চলেছে। এখন মোবাইলের ফ্ল্যাশ বা চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দেবী-কে বিদায় জানান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। আকবর আলি বলেন, পূর্ব পুরুষদের রীতি মেনে আমিও আলো দেখালাম দেবীকে।

এ ছাড়াও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের উদ্যোগে রবিবার মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকার কুমেদপুর তালগ্রাম হাটে অনুষ্ঠিত হল শতবর্ষ প্রাচীন আদিবাসী নৃত্য মেলা। কুমেদপুর তালগ্রাম হাট সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটি আয়োজিত এই আদিবাসী নৃত্য প্রতিযোগিতা মেলায় মালদার ১২টি সাঁওতালি নৃত্যের দল অংশগ্রহণ করেছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি আব্দুর রহিম বকশি, আদিবাসী সেলের নেতা চুনিয়া মুর্মু সহ অন্যান্যরা।

মেলা কমিটির আয়োজক আশরাফুল হক জানান, শতবর্ষ ধরে চলা এই আদিবাসীদের নৃত্যের মেলা এলাকার ঐতিহ্যর সাক্ষি হয়ে উঠেছে। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হলেও হিন্দু মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই মেলার আয়োজন করে থাকে। এলাকার অধিকাংশ মানুষই গরিব তাই ইচ্ছে থাকলেও পুজোয় আনন্দ করতে পারে না তাঁরা।কিন্তু পুজো শেষে এই মেলাতে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই হাতে হাত মিলিয়ে পুজোর আয়োজন করে থাকে।

আব্দুর রহিম বকশি জানান, এই ঐতিহ্যবাহী মেলায় আজ অংশগ্রহণ করতে পেরে তিনি আপ্লুত। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়    এমন সম্প্রীতির নজির সৃষ্টি করছে যা জেলা সহ রাজ্যের কাছে উদাহরণ তৈরি করবে।