ভিওসি রিপোর্ট
৯২ বছরে শেষ হলো ভারতীয় কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কর্মময় পথচলা। । রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে মধ্য মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে সম্প্রতি অবস্থার উন্নতিও হচ্ছিল। কিন্তু শনিবার আচমকা শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। দিতে হয় ভেন্টিলেশনে। সেখান থেকে আর ফেরানো যায়নি লতাকে। ভারতীয় সংগীতের কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালে ভারতের মধ্য প্রদেশের ইন্দোরে এক মারাঠি পরিবারে। পণ্ডিত দিনানাথ মঙ্গেশকরের বড় মেয়ে লতা। প্রথমে তার নাম রাখা হয় ‘হেমা’। জন্মের পাঁচ বছর পর তার নাম বদলে রাখা হয় লতা। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি সবার বড়। পিতা দিনানাথ ছিলেন থিয়েটার অভিনেতা এবং গায়ক।
পাঁচ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মঞ্চে অভিনেতা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তবে ওই সময় থেকেই গায়িকা হতে চেয়েছিলেন লতা। পিতা ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরাগী। এজন্য সম্ভবত তিনি লতার চলচ্চিত্রে গান করার বিরুদ্ধে ছিলেন। লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন (১৯৪২ সাল) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সী লতার ওপর। পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের। ছোটবেলায় মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাকে গান আর অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে শেখালেন। মারাঠী চলচ্চিত্রে গাওয়া তার গান ‘খেলু সারি মানি হাউস ভারি’ চলচ্চিত্রের ফাইনাল কাট থেকে বাদ পড়ে গেল। তবু দমে যাননি লতা। মাস্টার বিনায়ক তার চলচ্চিত্র ‘পাহিলি মঙ্গলা-গৌর’ এ লতা মঙ্গেশকরের জন্য ছোট একটি চরিত্র বরাদ্দ করেন। এ চলচ্চিত্রে দাদা চান্দেকারের রচনা করা গান ‘নাটালি চৈত্রাচি নাভালাল’এ কণ্ঠ দেন তিনি। তখনো চলছে তার জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ। চলচ্চিত্রের জীবনকে কখনো আপন করে নিতে পারেননি তিনি। একদিন কাজ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরলেন। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে জানান, এই কৃত্রিম অভিনয়ের জগৎ তার আর ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু করার নেই, পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে।
বিনায়কের মৃত্যুর পর সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দার হন লতার গুরু। ৮৪তম জন্মদিনে তিনি বলেছিলেন, গুলাম হায়দার তার জীবনে ‘গডফাদার’ ছিলেন। লতা মঙ্গেশকর শাস্ত্রীয় সংগীত শিখতে শুরু করেন উস্তাদ আমন আলি খানের কাছে। সেই সময় গুলাম হায়দার লতাকে আলাপ করিয়ে দেন প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শশধর মুখোপাধ্যায় লতার গলার স্বর শুনে বলেছিলেন, ‘বড্ড চিকন গলা’। কিন্তু হায়দার জানতেন, এমন একদিন আসবে যখন সবাই এই লতার পায়ে পড়ে থাকবে গান রেকর্ডিংয়ের জন্য।
১৯৪২ সালে লতার সংগীত ক্যারিয়ার শুরু মারাঠী গানের মাধ্যমে। হিন্দিতে লতা প্রথমবার প্লেব্যাক রেকর্ড করেন ১৯৪৩ সালে। মুম্বাই যাওয়ার পর হিন্দি সিনেমায় প্রথম গান করেন ১৯৪৬ সালে, সিনেমার নাম ‘আপ কি সেভা মে’। এর আগের বছর লতা এবং তার বোন আশা ভোঁসলে একটি সিনেমায় ছোট ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকজুড়ে একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েছেন রাহুল দেব বর্মণ ও লতা মঙ্গেশকর। তাদের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘অমর প্রেম’ (১৯৭২) সিনেমার ‘রায়না বেটি জায়ে’, ‘কারাভান’ চলচ্চিত্রের ‘চাদি জাওয়ানি’ ও ‘কিতনা পেয়ারা ওয়াদা হ্যায়’, ‘কটি পাতাং’ (১৯৭১) এর ‘আজ না ছোড়েঙ্গে’ এবং ‘আন্ধি’সহ (১৯৭৫) অনেক সিনেমার স্মরণীয় গান। লতা সবচেয়ে বেশি প্লেব্যাক করেছেন লক্ষ্মীকান্ত পেয়ারলালের সংগীত পরিচালনায়। এ সংখ্যা ৭১২। এছাড়া শংকর জয়কৃষাণ (৪৫৩), আর ডি বর্মণ (৩২৭), সি রামচন্দ্র (২৯৮), মদন মোহন (২১০), এস ডি বর্মণ (১৮২), নওশাদসহ (১৫৫) অনেক বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। চারপাশের এত এত সফলতার ভিড়েও ব্যক্তিজীবনে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হননি। লতা মঙ্গেশকরের একা থাকার কী কারণ? এ প্রশ্ন ও কৌতুহল তার ভক্ত-অনুরাগীদেরই। অবিবাহিত থেকে যাওয়া লতা একতরফাভাবে কেবলই কি সুরের সাধনায় নিজেকে খুঁজতে চেয়েছেন? সংসার ধর্মে কেন মন দিলেন না? এসব প্রশ্নের উত্তর সবার মনেই আসে, সেটাই স্বাভাবিক।
এই সুর সাম্রাজ্ঞীর বিয়ে নিয়ে অনেক আগে শোনা গিয়েছিল শৈশবকালে তিনি নাকি কুন্দনলাল সেহগলের চলচ্চিত্র ‘চণ্ডীদাস’ দেখে বলেছিলেন, বড় হয়ে তাকেই বিয়ে করবেন। তার সেই ইচ্ছে পূর্ণতা পায়নি বলে তিনি নাকি আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, গুঞ্জন ছিল লতা মঙ্গেশকর এ কসময় কাউকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু তার সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি। প্রেমে সফল হননি বলেই কারও সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাও হয়নি তার। এমনও শোনা যায়, রাজস্থানের (তৎকালীন রাজপুতনা) দুঙ্গরপুরের রাজ ঘরানার মহারাজ রাজ সিংয়ের প্রেমে পড়েছিলেন লতা। যিনি সম্পর্কে লতার বড় ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
তবে রাজ ঘরানার ছেলে রাজ সিং নাকি বাবা-মাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোন সাধারণ পরিবারের মেয়েকে তিনি রাজবংশের বউ করে আনবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা বজায় রেখেছিলেন। তিনিও আর বিয়ে করেননি। লতার চেয়ে ৬ বছরের বড় রাজ সিং আদর করে লতাকে ‘মিট্টু’ বলে ডাকতেন। তার পকেটে সব সময় থাকত একটি রেকর্ডার। তাতে রেকর্ড করা থাকত লতা মঙ্গেশকরের জনপ্রিয় কিছু গান। ২০০৯ সালে প্রয়াত হন রাজ সিং দুঙ্গারপুর।
বিয়ের ব্যাপারে লতা মুঙ্গেশকরকে যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়নি ব্যাপারটি তেমন নয়। তবে বিয়ে নিয়ে তার মন্তব্য ছিল ভিন্ন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার ভাষ্য ছিল সংসারের দায়িত্ব কাঁধে থাকার কারণেই তিনি নিজেকে নিয়ে কোনদিন আলাদা করে ভাবার সুযোগ পাননি।
সংগীতে বিশেষ অবদান রাখায় পুরস্কারের ঝুলিটাও বেশ ভারি কিংবদন্তি এ গায়িকার। ভারতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ফিল্মফেয়ারে ১৯৯৪ সালে ‘আজীবন সম্মননা পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি। ১৯৯৭ সালে পান ‘মহারাষ্ট্রভূষণ’ পুরস্কার। ১৯৯৯-তে জেতেন ‘এনটিআর জাতীয় পুরস্কার’। একই বছর ভারত সরকার তাকে দেন ‘পদ্মবিভূষণ’ পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে পান ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’। ২০০১ সালে ভারত সরকারের সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার ‘ভারতরতœ’ও লাভ করেন এ কিংবদন্তি।