কিশোর সরকার, বাংলাদেশ
ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর গত ছয় বছরে বাংলাদেশে আর নতুন কোনও মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া পুরনো মিটারগেজ রেলপথগুলিও পর্যায়ক্রমে ব্রডগেজ বা ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। তাই ২০ বছর পর দেশে মিটারগেজ রেলপথ আর থাকবে না। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল জোনে ৫৭০টি মিটারগেজ ওয়াগন রয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন খাত থেকে আয় হয়েছে ১৪৫ কোটি টাকা। আর সিলেট থেকে সার পরিবহন ও চট্টগ্রাম থেকে চাল, গম-সহ যে সমস্ত পণ্য পরিবহন করা হয় তা বর্তমার ওয়াগন দিয়েই করা সম্ভব। মিটারগেজ লাইনে বেশি পণ্য পরিবহনকারী সিলেট আগাউড়ার রেল লাইনের ত্রুটি থাকার কারণে ৩০টির পরিবর্তে ১২টি ওয়াগন নিয়ে মালামাল পরিবহন করতে হচ্ছে। তাই ২০১৩ সালে চিন থেকে কেনা ডেমো ট্রেনের ন্যায় এই মিটারগেজ ওয়াগনও ‘গলার কাটা’ হতে চলেছে বলে দাবি করছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
চিনের সিআরআরসি শ্যাংডং কোম্পানি লিমিটেড-এর কাছ থেকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৩৮৬টি কাভার্ড, ১৭৪টি খোলা ও ২০টি ব্রেক ভ্যান কিনতে চলেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে গত ২৮ ডিসেম্বর ৩১৮ কোটি ৬৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকার একটি ক্রয়চুক্তি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ২০২৩ সালের মার্চ-এপ্রিল থেকে এসব মিটারগেজ ওয়াগন আসা শুরু হবে। চুক্তি অনুযায়ী ১৮ থেকে ৩০ মাসের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার কথা ওয়াগনগুলি। তবে বর্তমানে পণ্যবাহী ট্রেনের বেশিরভাগই চলে পশ্চিমাঞ্চলে। এসব ট্রেনের প্রায় সবই ব্রডগেজ। এছাড়া করোনাকালে ভারত থেকে রেলপথে পণ্য আমদানি বেড়েছে। তবে চাহিদা না থাকায় মিটারগেজ ওয়াগন বসিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করছেন রেলওয়ে পরিবহন বিভাগ সংশ্লিষ্টরা। ফলে প্রকল্পের নামে অপচয় হবে বড় অঙ্কের অর্থ।
রেলের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তাদের ভাষ্য মতে, বাংলাদেশ রেলের কাছে থাকা ৫৭০টির মধ্যে ৩৭০টি ওয়াগন সচল রয়েছে। বাকিগুলিও সামান্য মেরামত করলেই সচল হয়ে যাবে।
এছাড়া বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে (পদ্মার পূর্ব পাড়) মূলত কন্টেনারবাহী ট্রেন ও তেলবাহী ট্রেনই চলে ওই অঞ্চলে। তাই নতুন কেনা পণ্যবাহী ওয়াগন বেশিরভাগ সময়ই বসিয়ে রাখতে হবে। ফলে কোনও দেশকে খুশি করতে আদৌ প্রকল্পটি প্রয়োজন আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে দাবি করছেন তাঁরা।
তবে বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, কোন দেশকে খুশি করতে নয়। মিটারগেজ রেললাইন ব্রডগেজে রূপান্তর করতে আরও ২০ বছর সময় লাগবে। তাই চিন থেকে এই মিটারগেজ ওয়াগন কেনা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০২১ সালে প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৮০৮টি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করে। এগুলিতে ১৮ লক্ষ ৮৩ হাজার ৩৪৫ মেট্রিক টন পণ্য পরিবহন করা হয়, যার প্রায় পুরোটাই পশ্চিমাঞ্চলে (পদ্মার পশ্চিম পাড়)। আর এই রেললাইন পুরোটা ব্রডগেজ। এছাড়া ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন, অক্সিজেন এক্সপ্রেস ট্রেন ও ভারত থেকে আমদানি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করে, যার সবই পশ্চিমাঞ্চলে।
বাংলাদেশ রেলের একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক দশক আগেও দেশের মোট আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ১০ ভাগ রেলের মাধ্যমে পরিবহন করা হত। এখন তা পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এর মূল কারণ বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সড়কপথে পণ্য পরিবহনে সময় রেলপথের তুলনায় কম লাগে। এছাড়া যাত্রীবাহী ট্রেনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে অনেক সময় পণ্যবাহী ট্রেন বসিয়ে রাখা হয়। তাই নতুন মিটারগেজ ওয়াগন কেনার প্রকল্প অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয় বলে দাবি করছেন তিনি।
উল্লেখ্য, একইভাবে ২০১৩ সালে ৬৫৪ কোটি টাকা খরচে চিন থেকে ২০ সেট ডেমো ট্রেন কেনা হয়। তবে পাঁচ বছর যেতনা যেতে সকল ডেমো ট্রেন বিকল হয়ে যায়। অকেজো ট্রেনগুলো আজ ভাঙাড়ির দোকানেও বিক্রির উপায় নেই। আর যে ৩০ কর্মকর্তা ডেমো ট্রেন কিনতে বিদেশ সফরে করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন আইনি পদক্ষেপ।
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন, বাংলাদেশে কেনাকাটায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কারো বিচার হয়না। তাই অনেক ক্ষেত্রে সরকারের উপরমহলের লোকেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তবে এ-মিটারগেজ ক্রয় প্রকল্প যেন ডেমো ট্রেনের মতোন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।