অক্টোবর থেকে  এ পর্যন্ত গ্রেফতার ৫৯জন ॥ হিজরতের নামে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেয় তারা
ঢাকা থেকে হরলাল রায় সাগর

বাংলাদেশে ফের জঙ্গিতৎপরতার ভয়ানক খবর। এবার জঙ্গি সংগঠনের আলোচনায় রয়েছে পাহাড়ে আস্তানা গাঁড়া ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। কথিত এই জঙ্গি সংগঠনের চার সদস্য মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম রয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে ‘সংগঠনটির আমিরের নির্দেশে পার্বত্যাঞ্চল ছেড়ে সমতলে নেমে এসেছিলেন বলে জানিয়েছে র‍্যাব। র‍্যাব অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বাইপাস থেকে তাদের গ্রেফতার করে। এই খবর জানায়  এলিট ফোর্স র‍্যাব। গ্রেফতাকৃত চারজন হলেন- হোসাইন আহমদ (২২), নিহাল আব্দুল্লাহ (১৯), আল আমিন (২২) এবং আল আমিন ওরফে পার্থ কুমার দাশ (২১)। পার্থ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ২০১৮ সালে আল আমিন নাম নেন বলে র‍্যাব জানিয়েছে। আর নিহাল ২০২২ সালের আগস্টে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের একজন, যিনি কথিত হিজরতের জন্য বাড়ি ছেড়েছিলেন। নিহালকে নিয়ে ওই আটজনের সবাই এখন গ্রেফতার হলেন। তাদেরকে রাঙামাটির বিলাইছড়ি থানার একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া কেএনএফ’র ১৭ সদস্যকে গ্রেফতারের  কথা জানা গেলেও  তাদরে সম্পর্কে র‍্যাব বিস্তারিত জানায়নি।

সমতল এলাকা পটিয়া থেকে তাদের গ্রেফতার করা হলেও ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনটি পাহাড়ি সংগঠন বম পার্টি বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’-এর সঙ্গে মিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন বনে আস্তানা গেঁড়েছিল বলে র‍্যাবের পক্ষ থেকে এর আগে  জানিয়েছিল।

আজ বুধবার (১ মার্চ) চট্টগ্রামে র‍্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘‘গ্রেফতারকৃত চারজন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ‘তাত্ত্বিক জ্ঞান’ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে যান। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে সেনাবাহিনীর টহল ও র‍্যাবের টানা অভিযানে জঙ্গি সংগঠনটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাই সংগঠনের আমিরের নির্দেশে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সমতলে চলে আসছিল।’’

তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রশিক্ষণে গিয়েছিল এমন একটি দল আত্মগোপন করতে কিংবা তাদের পরবর্তী মিশন সম্পন্ন করতে সমতলের দিকে আসছে এমন তথ্য পায় র‍্যাব। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে পটিয়া বাইপাসের চেকপোস্টে একটি অটোরিকশা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তারা চট্টগ্রামের দিকে আসছিলেন।’ গ্রেফতারের বরাত দিয়ে র‍্যাবের এ সদস্য বলেন, তাদের পেছনে ৪/৫ জনের আরেকটি দল ছিল। যারা চেকপোস্ট দেখে পালিয়ে যান। এ সময় এদের কাছে বিভিন্ন তথ্যসহ সহ ভিডিও ক্লিপিং পাওয়া গেছে এমন তথ্য জানিয়ে  কমান্ডার মঈন বলেন, এটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর আগে গত ২৪ জানুয়ারিও এধরনের একটি ভিডিও কনটেন্ট পাওয়া গেছে।

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে হোসাইন ঢাকার আর আল আমিন কুমিল্লার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। নিহাল কুমিল্লার একটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে লেখা-পড়া করতো।। আর আল আমিন (পার্থ কুমার দাশ) খুলনার একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। ২০১৮ সালে স্থানীয় এক ইমামের মাধ্যমে পার্থ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ঢাকায় সিকিউরিটি গার্ডের কাজ নেন।

র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, আট তরুণের যে দলটি কুমিল্লা থেকে হিজরতের নামে ঘর ছেড়েছিলেন তাদের নেতৃত্বে ছিলেন নিহাল। ২০২০ সালে এক বন্ধুর মাধ্যমে কুবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়ায় তারা। ২০২২ সালের ২৩ আগস্টে অন্য তরুণদের সঙ্গে হিজরতের জন্য ঘর ছাড়েন তারা। তিনি বলেন, পরে সেপ্টেম্বরে সংগঠনের শুরা সদস্য রাকিবের মাধ্যমে নিহাল পার্বত্য অঞ্চলের কেএনএফ’র প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যান এবং বিভিন্ন অস্ত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এর আগে ২০২১ সালের নভেম্বরে হোসাইন ও দুই আল আমিন ওই কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তিনি বরেন, ‘কুমিল্লা থেকে ঘর ছেড়ে আসা তরুণদের মধ্যে কয়েকজন ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেও নিহাল তাদের বিভিন্ন বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়ে আটকে রেখেছিলেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র প্রশিক্ষণে যেতে বাধ্য করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, ‘র‍্যাব বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাখার প্রধান বা অন্যন্য কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে সংগঠনের আমির আনিসুর রহমান মাহমুদ, অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান রাকিবসহ অনেককেই আইনের আওতায় আনা যায়নি।’

র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, গত অক্টোবর থেকে এই পর্যন্ত ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার’ ৫৯ জনকে গ্রেফতার করেছেন তারা। এদের মধ্যে অনেকেই তথাকথিত হিজরতের নামে স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন।

এদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ’র ১৭ সদস্যকেও গ্রেফতার করার কথাও সংবাদ সম্মেলনে  জানানো হয়, যারা শারক্বীয়াকে অর্থের বিনিময়ে অস্ত্রসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিল বলে র‍্যাব জানায় । এর আগে এ জঙ্গি সংগঠনের কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতারের পর ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল র‍্যাব।

কমান্ডার আল মঈন জানান, হিজরতের নামে জঙ্গিবাদে জড়ানো যে ৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১২ জন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ৩১ জন নভেম্বরে এবং ১২ জন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে পার্বত্য অঞ্চলে যান। এদের মধ্যে ২৭ জনকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়েছে; দুজনের মৃত্যু হয়েছে।’

কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় দাবি করেছে তারা বাংলাদেশের কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। একই সঙ্গে তারা জানিয়েছে, তাদের ভাষায়, ‘সুবিধা বঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য” চাইলেও তারা কোন স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি

এইচ-ভি ৬