নিজস্ব প্রতিবেদন

নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর থেকেই উত্তর প্রদেশে শুরু হয়ে গেছে দলবদলের খেলা। চলছে মেরুকরণের রাজনীতি ।প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে  সেখানকার রাজনৈতিক সমীকরণ। এরই মধ্যে পর পর দুটি বড় ধাক্কা খেল উত্তর প্রদেশর বিজেপি  সংগঠন। মঙ্গলবার শ্রমমন্ত্রী স্বামী প্রসাদ মৌর্যের ইস্তফার পর এবার আরও এক শীর্ষ নেতা, দারা সিং চৌহান-ও দল ছাড়লেন। এই নিয়ে দুদিনেই পরপর দু’জন ওবিসি(অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়) জনজাতির নেতা বিজেপি ছাড়লেন

আগামী বিধানসভা ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন  শুরু। ৪০৩ কেন্দ্রের এই নির্বাচনে জনজাতি/উপজাতিদের ভোট বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ রাজ্যের একটি বড় অংশ যেমন ব্রাহ্মণ, তেমনই অপর একটি বড় অংশের মানুষই বিভিন্ন জনজাতি বেষ্টিত। তাই নির্বাচনে জেতার জন্য দুই পক্ষের মধ্যেই ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে জয়ের রণকৌশল তৈরি করতে দিল্লিতেই যখন সমস্ত শীর্ষনেতারা ব্যস্ত, সেই সময়ই মঙ্গলবার বিজেপি ও মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন  স্বামী প্রসাদ মৌর্য্য।  তিনি জানান, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান করবেন, তবে এই বিষয়ে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। এরইমাঝে আরও প্রকট হল বিজেপির অন্দরের ফাটল।  দল থেকে বুধবার  দল থেকে ইস্তফা দেন দারা সিং চৌহান। এছাড়া বিজেপি বিধায়ক অবতার সিং ভাদানাও বিজেপি ছেড়ে রাষ্ট্রীয় লোক দলে যোগদান করার কথা জানান। এর পরই স্বামী প্রসাদ মৌর্য্যকে সমর্থন দেখিয়ে  বিজেপি ছাড়েন ৩ বিধায়ক- রোশনলাল শর্মা, ব্রিজেশ প্রজাপতি, ভগবতী সাগর। স্বামীপ্রসাদের বিজেপি ত্যাগের পরই ছবি পোস্ট করে তাঁকে স্বাগত জানান অখিলেশ যাদব। তারাও অখিলেশ যাদবের নেতৃত্বাধীন সমাজবাদী পার্টি (সপা)-তেইযোগদান করার আভাস দিয়েছেন। এরই মধ্যে বিজেপি ছেড়ে আসা নেতাদের সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান করার জন্য আহবান জানিয়েছেন অখিলেশ যাদব। অন্যদিকে,  নতুন সদস্যও পেয়েছে বিজেপি। বুধবার কংগ্রেসের বিধায়ক নরেশ সাইনি ও সমাজবাদী পার্টির হরিওম যাদবও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।

বিগত কয়েক মাস ধরেই ভারতের সব থেকে বড় রাজ্যে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। ভোটের মুখে বিভিন্ন সভা সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট টানতে  মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যানাথের মুখে ‘আব্বাজান’ বা ‘কবরস্থান’-এর মতো বিপরীতমুখী এইরকম বেশ কিছু শব্দ ব্যাবহারের  প্রসঙ্গ টি উঠে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে উত্তর প্রদেশে জাতপাত ও ধর্ম নিয়ে রাজনানীতি দীর্ঘদিনের। অতীতেও ধর্মীয় মেরকরণ ও জাতপাতের রাজনীতিকে হাতিয়ার করে সফল হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। তাই এবারের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলগুলি কম বেশি সেই অস্ত্রকে ব্যবহার করতে চাইছে। তাতে সর্বশেষ সংযোজন যোদী আদিত্যানাথের ওই মন্তব্য।

প্রসঙ্গত, ভারতীয় রাজনীতিতে কথিত আছে, “দিল্লির মসনদ অনেকটা নির্ধারিত হয়ে থাকে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোট।”  তাই এবারও ৪০৩ আসনের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখা বিজেপির কাছে একটি  বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ এবার নির্বাচনে বিজেপি জয়ী হয়ে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন জয়ের পথ অনেকটা মসৃণ হবে বলে মনে করছে গেরুয়া শিবির। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দেশের  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও উত্তর প্রদেশে বারণসী থেকে নির্বাচিত হয়েই সাংসদ হয়েছেন। তাই উত্তর প্রদেশের বিজেপির ফল খারাপ হলে তার দায় মোদীর ওপরও পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাই উত্তর প্রদেশের একদিকে একাধিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সূচনা ও পাশাপাশি ধর্মীয় মেরুকরণকে হাতিয়ার করেই ভোট বৈতরণী পার হতে চাইছে বিজেপি।

আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ অবধি ধাপে ধাপে নির্বাচন রয়েছে উত্তর প্রদেশে। ফল ঘোষণা ১০ মার্চ। এরই আগে একের পর এক নেতা, বিশেষ করে জনজাতি গোষ্ঠীর নেতাদের দলত্যাগে কিছুটা চাপেই রয়েছে শাসক দল বিজেপি। সদ্য ইস্তফা দেওয়া মন্ত্রী স্বামী প্রসাদ হলেন মৌর্য্য কুশওয়াহা জাতির জনপ্রতিনিধি। মোট পাঁচবার বিধায়ক পদে ছিলেন তিনি। বহুদিনের রাজনীতিক তিনি। এর আগে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টিতে ছিলেন তিনি। পরে ২০১৬ সালে পদ্ম শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশের পাদ্রৌনা বিধায়ক। তাঁর মেয়ে সংঘমিত্রাও বিজেপির সাংসদ। এই মৌর্য্য কুশওয়াহা  সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে পূর্ব উত্তর প্রদেশের ভোটবাক্সে। গোটা উত্তর প্রদেশে এদের ভোটের হার ৫ শতাংশ। উত্তর প্রদেশের মোট ৪০৩ টি আসনের মধ্যে ৪০-৫০ টি আসনেই এদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।

এমনিতেই কৃষি আইন ও কৃষক আন্দোলনের জেরে কিছুটা ভোটবাক্সে প্রভাব পড়েছে বিজেপির। তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকেই  বিজেপি নেতা- কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যে কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছে তার সুফলের কথা জানাচ্ছেন এবং ডবল ইঞ্জিন সরকারের উপকারিতা বোঝাচ্ছেন। তবে উত্তর প্রদেশে রাজনৈতিক চিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল বিভিন্ন জনজাতি। বিশাল রাজ্যে বিভিন্ন জনজাতি ববাস করায়, তাদের সকলের চাহিদাও ভিন্ন। এদের গোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য বিভিন্ন নেতারাও রয়েছেন। অতীতেও দেখা গিয়েছে, নেতাদের দলবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভোটও পরিবর্তিত হয়েছে।  এবারও সেই একই ঘটনা ঘটবে কিনা, তাই-ই এখন দেখার বিষয়।

দেশের সবচেয়ে বড় বিধানসভা উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে এবার  যে ইস্যুগুলি  কি-ফ্যাক্টর হতে পারে, তার মধ্যে  রামমন্দির নির্মাণের সাফল্য, লখিমপুর খেরিতে কৃষক হত্যাকাণ্ড, হাথরস কাণ্ড ও উন্নাওকাণ্ড, আনগ্রসর জনজাতি, নারী উন্নয়ন সহ যুবগোষ্ঠি-র উন্নয়নে তেমন কোন কাজ না করা। এই সবকিছু মাথায় নিয়েই এবার লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে।এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উত্তর প্রদেশে বিজিপি, সপা সহ বিভিন্ন ভোটে গেরুয়া শিবিরের পারফরম্যান্স কেমন হবে? তারই আভাস পেতে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা  চালায় সি ভোটার ও এবিপি আনন্দ। তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী, উত্তরপ্রদেশের ৪০৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি  পেতে পারে ২২৩ থেকে ২৩৫টি আসনে। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি পেতে পারে ১৪৫ থেকে ১৫৭টি আসন। মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি জিততে পারে ৮ থেকে ১৬টি আসনে। আর প্রিয়ঙ্কা গাঁধী নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস জিততে পারে মাত্র ৩ থেকে ৭টি আসনে। ৪ থেকে ৮টি আসনে অন্যান্যরা জিততে পারে বলে আভাস মিলেছে সি ভোটারের সমীক্ষায়।পাশাপাশি সম্ভাব্য ভোট শতাংশের একটি ছবিও  সমীক্ষায় দিয়েছে তারা । সমীক্ষা অনুযায়ী উত্তরপ্রদেশে প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পেতে পারে বিজেপি।৩৩ শতাংশ ভোট যেতে পারে সমাজবাদী পার্টির ঝুলিতে।মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি  প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট পেতে পারে।৭ শতাংশ ভোট পেতে পারে কংগ্রেস। অন্যরা ৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে বলে সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কার নারীদের উন্নয়নসহ কল্যাণমূলক প্রকল্পের অগণিত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, তিনি এই ভোটে রাজ্যে কংগ্রেস পার্টির  হাল ধরতে পারবেন বলেও সমীক্ষা বলছে। তবে কংগ্রেসের ভোটের পরিমাণ সামান্য বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।  যেখানে ২০১৭ সালের  উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে আসনের সংখ্যা ৭ ছিল, এবার তা কমে হতে পারে ৫, এমনটাই আশঙ্কা সমীক্ষায়।