এম এ রহিম বাংলাদেশ থেকে

বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের সু সম্পর্ক। সৌহার্দ ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধনে আবদ্ধ দুটি দেশ।  বিপুল  আশা আকাঙ্খা নিয়ে উভয় দেশ বহু দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে প্রবেশ করেছে এবং সেই বিষয়ে অনেজগুলো সমঝোতাচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চারদিনের এই সফরকে সিগনিফিকেন্ট এচিভমেন্ট হিসেবে দেখছেন ুভয় দেশ। চারদিনের সফল সফরের শেষ পর্যায়ে  ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধামমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাধেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে তারা উভয়েই (ভারত-বাংলাদেশ) সীমান্তে হত্যার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে এই বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সীমান্তের ওপারে চোরাচালান ও পাচার বন্ধে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীদের প্রচেষ্টারও প্রশংসা করেছেন তারা। দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীরা একমত হয়েছেন যে সীমান্ত হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে এবং এই জন্য  এখনও  কিছু করার আছে।

কিন্তু  এমনই পরিহাস যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশের কয়েক ঘন্টা পরে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার দাইনুর সীমান্তে মিনারুল ইসলাম নামে এক নাবালক বাংলাদেশী স্কুল ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হুয়। অনুমান  ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সীমান্তরক্ষীদের হাতে হত্যার সংখ্যা এই দশকে ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

আমরা এই বিবৃতির মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়া সরকারগুলির রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের প্রতিবাদ জানাই, যা সত্য গোপন করা, মিথ্যা তথ্য প্রচার করা এবং সীমান্তের জনগণের দুর্ভোগকে অজ্ঞান করা। আমরা দাবি করি যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যার সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা উচিত এবং দোষী সীমান্তরক্ষীদের তাদের ট্রিগার-সুখী মনোভাবের জন্য আইনের আওতায় বিচার করা উচিত। যদি উভয় দেশের সরকারের সত্যিকারের উদ্দেশ্য হয় সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, তাহলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে দায়মুক্তির অবসান ঘটিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করা উচিত।

সীমান্ত রক্ষীরা, যারা চোরাচালান রোধে তাদের প্রচেষ্টার জন্য প্রধানমন্ত্রীদের প্রশংসা করছেন। পালাক্রমে অপরাধীরা যারা সীমান্তের ওপারে ক্রস বর্ডার চলাচলে সহায়তা করছে। এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে যে, উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী আন্তঃসীমান্ত চলাচলে সহায়তা না করলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মাদকদ্রব্য ও গবাদি পশুর পাচার সম্ভব হতো না। উভয় দেশের বাহিনীতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছে যারা সীমান্তের ওপারে এ ধরনের অবৈধ ব্যবসায় সহায়তা করে। তাছাড়া সীমান্তের ওপারে গবাদি পশু ও মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কিংপিনদের নজরে পড়ে না এবং কিছু নগদ অর্থের জন্য চোরাচালানের দিকে ঝুঁকে থাকা প্রান্তিক ‍ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। যাইহোক, প্রধানমন্ত্রীদের দ্বারা সীমান্ত রক্ষীদের পদক্ষেপের প্রশংসা করা হয় ইস্যুতে তাদের নির্লজ্জতার প্রতিফলন বা এই দুই প্রতিবেশী দেশের বাহিনীর অবৈধ কর্মকাণ্ডকে দমন করার তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে প্রতিফলিত করে। ভারত সফরে থাকা শেখ হাসিনার সাথে নরেন্দ্র মোদী ওয়াদা করেছিলেন সীমান্ত হত্যা জিরোতে নামিয়ে আনা হবে। তাঁর এমন ওয়াদার দিনেই দিনাজপুরের দাইনুর সীমান্তে স্কুল ছাত্রকে হত্যা করেছে বিএসএফ।

বিএসএফ’র গুলিতে নিহত হওয়া খানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মিনার বাবুর। ৫দিন পর গত সোমবার ( ১২ সেপ্টেম্বর)  সন্ধায় লাশ ফেরত দেয় ভারতীয় বিএসএফ।   এর দু’দিন আগে শুক্রবার বিকালে কুমিল্লা ব্রান্মনপাড়া সীমান্ত এলাকা থেকে উদ্ধার হয় আরে একট যুবকের লাশ। মঙ্গলবার দুপুরে বেনাপোল রঘুনাথপুর সীমান্তের ভারতীয় কাটাতারের বেড়ার নিকট থেকে অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনীধি আলম হোসেন.রুহিল আমিন জানান বিএসএফের নির্যাতনেই মৃত্যু হয়েছে তার। যুবকের শরীরে অনেক অঘাতের চিহ্ন রয়েছে। যশোর ৪৯ বিজিবি অধিনায়ক মিনহাজ্ব সিদ্দিকী ও এ এসপি জুয়েল ইমরান বলেন সীমান্ত এলাকা থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সুরত হাল রিপোর্ট তৈরী করা হয়েছে।  যশোর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

স্থানীয় সুত্রে জানায় দিনাজপুর  সীমান্তের কাছে গুলি করে স্কুল ছাত্রের হত্যার পর লাশ নিয়ে যায় বিএসএফ। এরপর থেকে বাংলাদেশ বিজিবি বাহিনী বিএসএফ-এর সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখলেও ৪দিনেও লাশ ফেরত আনতে ব্যর্থ হচ্ছে বিজেবি। যেদিন এই স্কুল ছাত্রকে সীমান্তে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন থেকেই পরিবারের সদস্যরা লাশে অপেক্ষায় সীমান্তের কাছে প্রহন গুনেছেন। প্রতিটি মূহুর্ত পরিবারের সদস্যরা লাশ ফেরত পাওয়ার  অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। প্রত্যাশা ছিল শনিবার পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাদের সন্তানের লাশ ফেরত পাবেন। কিন্তু পতাকা বৈঠক হলেও লাশ ফেরত আসেনি। সন্ধ্যায় শূন্যহাতে ফিরেছেন স্বজনেরা।

বিজিবির দাইনুর সীমান্ত ফাঁড়ির সামনে অপেক্ষা করতে থাকে নিহত মিনারের পরিবারসহ এলাকাবাসী।  বিজিবি-বিএসএফ কোম্পানি কমান্ডার পর্যায়ের বৈঠকে শুধুমাত্র লাশ শনাক্ত করা হয়।  অবশেষে মঙ্গলবার  ফেরত দিয়েছে মরদেহ।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার ভোর রাতে দিনাজপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর কমলপুর ইউনিয়নের দাইনুর বিওপি ৩১৪/১ নম্বর মেইন পিলারের কাছে বিএসএফ-র গুলিতে নিহত হয় খানপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির মিনার বাবু। এসময় আরো দুইজন গুলিতে আহত হয়েছিল বলে জানা যায়।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে কোনো আলোচনা না হওয়াকে হতাশাজনক বলে বর্ণনা করেছে ভারতীয় মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)।  শুক্রবার সংগঠনটি এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।

কলকাতাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারতের ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) সরকারের সময় (২০০৪-১৪) সীমান্তে বছরে গড়ে ১৫০ জন নিহত হতেন। ২০১৪ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) ক্ষমতায় আসার পর বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০।

বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বাড়ার কারণ, কংগ্রেস সরকারের আমলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র (নন-লেথাল উইপন) ব্যবহার করত। ২০১৪ সালের পর বিএসএফ আবার প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার শুরু করে।

মানবাধিকার সংগঠনের  সম্পাদক কিরীটি রায়  বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা আশা করেছিলাম, এ বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু হলো না। দুই রাষ্ট্রপ্রধানের যৌথ বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দিনাজপুরে গুলি চালিয়ে এক কিশোরকে হত্যা ও মরদেহ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। এটা সীমান্তের দুই পারের মানুষের জন্যই উদ্বেগের ও দুঃখজনক।’
সংগঠনটি বলেছে, ‘সীমান্তে হত্যা হঠাৎ বেড়েছে বলে আমাদের পরিসংখ্যান বলছে। অথচ দুই প্রধানমন্ত্রী সীমান্তে হত্যা কমে যাওয়া নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।’সীমান্তে মানব পাচার, পশু চোরাচালান ও মাদক চালানের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ড দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মদদ ছাড়া সম্ভব নয় বলেও সংগঠনটির বিবৃতিতে দাবি করা হয়।

কিন্তু দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বা বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে আলোকপাত না করার বিষয়টিকে হতাশাজনক উল্লেখ করে সীমান্তে প্রতিবছর কত মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দাবি করেছে সংগঠনটি। বলা হয়েছে, যদি দুই দেশের সরকারের এমন লক্ষ্য থাকে, তাহলে হত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী। তা হলেই দায়ী যারাই হোক কথায় কথায় নিরীহ ব্যক্তিদের অস্ত্র চালিয়ে হত্যা করতে ভয় পাবে।