ডেক্স রিপোর্ট

আফগানিস্তান এখন তালিবানিস্তান।  বিভিন্ন সংবাদসংস্থার দাবি, কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে রবিবার থেকে এখনও পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। তালিবানের গুলিতে আফগানিস্তানের বিভিন্ন শহরে মৃত্যু হয়েছে বহু মানুষের। এই সব দেখে আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠছে আফগানিস্তানের জনসাধারনের মন।শান্তির বারতা শুনালেও আফগানিস্তানে ফের স্বমহিমায় ফিরছে তালিবানি রাজ। আফগানিস্তানের রাস্তাঘাট ,দোকানে বন্দুক হাতে  দেখা যাচ্ছে তালিবানদের। আফগানিস্তানে এখন চারিদিকে আতঙ্কের ছবি। অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে পেরেছেন, অনেকে আবার পারেননি। পালাতে গিয়ে অনেকে ধরা পড়ে তালিবানদের হাতে। রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন চেকপোস্টে নাকা চেকিং চালাচ্ছে তালিবানরা। ঘর থেকে বের হতেই পারছেন না কেউ। ঘরে খাবার নেই। সবার মনে আতঙ্ক,  তালিবানরা কখন এসে  ঘরের দরজায়  হানা দেবে।

এই বারুদ উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ও শহরে আটকে পড়েছেন ভারতের অনেক নাগরিক। চরম দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে জলপাইগুড়ির  দুই পরিবারের লোকজন। আফগানিস্তানে আটকে রয়েছেন তাঁদের পরিজনেরা । তালিবান আতঙ্কে গৃহবন্দি হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। জলপাইগুড়ির মাল ব্লকের ওদলাবাড়ির  বিধানপল্লি এলাকার বাসিন্দা আমানুল্লা খান জানান, ‘আমার দিদি, জামাইবাবু এবং দুই ভাগ্নে বর্তমানে আফগানিস্তানে রয়েছে। গত ১৫ বছর আগে আমার দিদি, বিবি আইসা খানের বিয়ে হয় আফগানিস্তানে। আমানুল জানান, সেখানে তার দিদি মানুষের চিকিৎসা করেন  আর দুলাভাই হাসপাতালের কমপাউন্ডার। ৫দিন আগে ভিডিও কলের মাধ্যমে আমানুলের সঙ্গে কথা হয় তাঁর দিদির। জানান, বাড়ির বাইরে বের হতে পারছেন না তাঁরা। দোকানপাট বন্ধ। বাড়িতে খাবার নেই। পরিজনদের যাতে দেশে ফেরানো যায় সে বিষয়ে ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে আমানুলের পরিবার।

অন্যদিকে, ওদলাবাড়ির বাসিন্দা ইলি ছেত্রী খান জানান, তাঁর দিদি বর্তমানে আফগানিস্তানের খেরকোটে আটকে পড়েছেন। খেরকোট থেকে কাবুল বিমানবন্দরের দূরত্ব ৪০০ কিমি। সেই রাস্তার বিভিন্ন চেকপোস্টে নাকা চেকিং চালাচ্ছে তালিবানরা। ঘর থেকে বের হতেই পারছেন না পরিজনেরা। ঘরে খাবার নেই। এই অবস্থায় দিদির পরিবারকে কীভাবে দেশে ফেরাবেন, ভেবেই পাচ্ছেন না  ছেত্রি খান।।   আফগানিস্তানে কাজ করতে গিয়ে আটকে রয়েছেন নদিয়ার বহু বাসিন্দা। অগ্নিগর্ভ কাবুলের ছবি দেখে উৎকণ্ঠায় রয়েছে তাঁদের পরিবার। দ্রুত পরিজনকে দেশে ফেরানোর দাবি করেছেন তাঁরা। কাবুলে আটকে রয়েছেন নদিয়ার তাহেরপুরের বাসিন্দা কৃষ্ণ দাস ও অশোক ঘোষ। মাস ছ’য়েক আগে কর্মসূত্রে কাবুলে যান তারা। দু’জনেই মার্কিন দূতাবাসে  কাজ করতেন। বর্তমানে তারা সেখানেই আটকে রয়েছেন।  কৃষ্ণ দাসের স্ত্রী মৌমিতা দাস বললেন, যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি, এই পরিস্থিতে সম্ভ হচ্ছেনা। আমরা খুব আতঙ্কে আছি। অন্যদিকে, অশোক ঘোষের স্ত্রী সুমিত্রা বললেন, আমর চাই আমাদের সরকার খুব তাড়িতাড়ি তাদের ফিরিয়ে আনুক।।

সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে দেশে ফিরেছেন নদিয়ার রানাঘাটের বেগোপাড়ার বাসিন্দা সুপ্রিয় মিত্র ও শানু গঞ্জালভেস। দুজনেই কাবুল এয়ারপোর্টে অস্থায়ী মার্কিন দূতাবাসে রাঁধুনির কাজ করতেন। ২০১৯-এর জানুয়ারি থেকে সুপ্রিয় ওই দেশে। আর শানু গিয়েছিলেন ২০২০-তে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই শান্ত কাবুলকে চোখের সামনে ধীরে ধীরে অশান্ত হতে দেখেছেন তাঁরা। দেশে ফিরে সুপ্রিয় বলেছেন, শেষ দু’মাস কাবুল এয়ারপোর্টে কাজ করেছি। চোখের ওপর পরিবেশ বদলাতে দেখেছি। নিজে চোখে দেখেছি গ্রেনেড, বোমা পড়তে। যত দেখছি, তত ভয় লাগছে। প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেরা দেশে ফিরেছেন। তাঁদের এখন একটাই প্রার্থনা, নিরাপদে দেশে ফিরুক অন্যান্য ভারতীয়রা। শানু বললেন, সমবয়সী অনেকেই রান্নার কাজে গেছি। অনেকে ফিরতে পারেনি অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।

আটকে পড়েছেন  দার্জীলিঙ্গ পাহাড়ের ৪ বাসিন্দা। অশান্ত আফগানিস্তানের পরিস্থিতি দেখে আশঙ্কায় রাত কাটছে পাহাড়ের এই চার পরিবারের লোকজন। গত জুলাই মাসে আফগানিস্তানে কাজের সূত্রে গিয়েছিলেন কার্সিয়াংয়ের বাসিন্দা শেখর গুরুং। সেখানেই বছর খানেক ধরে কাজ করছিলেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু কয়েকদিন ধরে শেখর গুরুংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। ইতিমধ্যেই খবরে আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন কায়েমের খবর জানতে পারে পরিবার। এতেই চিন্তা বেড়েছে তাদের মনে

 

কার্সিয়াংয়ের মন্টেভিট এলাকার বাসিন্দা সুনীল সুব্বাও দীর্ঘদিন ধরে কাবুলে একটি বেসরকারি সংস্থার অধীনে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন। সুনীল সুব্বার সঙ্গে গত সোমবার শেষ যোগাযোগ করতে পেরেছিল তাঁর পরিবার। তারপর থেকে সব যোগাযোগ ছিন্ন। একই পরিস্থিতি কার্সিয়াংয়ের বাসিন্দা জিতেন মোক্তানের। তিনিও সেখানে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করতেন। দার্জিলিংয়ের লেবংয়ের বাসিন্দা অমিত গুরুংও কাবুলে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।  রাজনৈতিক অশান্তির জেরে সেখানে সে আটকে পড়েছেন বলে পরিবারের দাবি। দার্জিলিং জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যে জেলায় আটকে থাকা প্রত্যেকের তথ্য জোগাড় করতে শুরু করেছে। জেলা শাসক  বলেন, ‘পাহাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা আফগানিস্তানে আটকে রয়েছেন এমন খবর পেয়েছি। আমরা সমস্ত তথ্য জোগাড় করে পরিবারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি।’

আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন রাজ্য প্রশাসনও। নয়াদিল্লির সঙ্গেও এ বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এ রাজ্যের বাসিন্দাদের খোঁজখবর নিয়ে তাঁদের নিরাপদে ফেরানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে প্রতিটি জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে নবান্ন। মঙ্গলবারই সেই নির্দেশ পৌঁছেছে জেলা শাসকদের কাছে।

আফগানিস্তানের এরকম অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাঁকুড়া শহরে বসবাসকারী আফগানরা। ব্যবসার সূত্রে কেউ আজ থেকে একশো বছর কেউ বা দেড়শো বছর আগে আফগানিস্থান থেকে চলে এসেছিলেন এদেশে। তারপর দেশের বিভিন্ন শহর ও রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। শুরু করেছিলেন পেস্তা, বাদাম, খেজুরের ব্যবসা। কালক্রমে এ দেশকেই একসময় নিজেদের দেশ করে নেন তাঁরা। কিন্তু তাদের মন আর প্রাণের টান পড়ে থাকে আফগানিস্থানেই। তালিবান দখল দফল নেয়ায়  স্বাভাবিক ভাবেই উদ্বিগ্ন তাঁরা। আত্মীয় স্বজনরা কী অবস্থায় রয়েছেন তা নিয়ে উদ্বেগ এখন তাঁদের চোখেমুখে।

বাঁকুড়া শহরের মাচানতলার অদূরেই একটি পুরানো বাড়িতেই ওইসব আফগান গড়ে তুলেছিলেন তাদের আস্তানা। ধীরে ধীরে সেই বাড়িকে ঘিরেই গড়ে ওঠে ‘কাবলি পট্টি’। আজও সেই কাবলি পট্টিতে বসবাস করেন জনা তেরো কাবুলিওয়ালা। এদের বেশিরভাগেরই জন্ম এদেশে। শেকড়ের টানে অনেকেই আফগানিস্থানে ঘুরে এসেছেন। এখনো অনেকের জমি জিরেত ভিটে মাটি রয়েছে সেদেশে। সে দেশে ছড়িয়ে আছে আত্মীয় বন্ধু স্বজনরা। তালিবান কাবুল দখলের আগে পর্যন্ত সেই আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল নিয়মিত। কিন্তু তালিবান কাবুল দখল নিতেই সেই যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।

গত কয়েকদিন ধরে আফগানিস্তানের কাবুলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। গোটা ব্যাপারটির ওপর নজর রাখছে ভারত। সরকার আগেই ঘোষণা করেছিল আফগানিস্তানের হিন্দু ও শিখ নাগরিকদের দেশে ঠাই দেওয়া হবে কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সরকার এবার  জানিয়ে দিয়েছে আফগান ভাইবোনেরা যারা ভারতের কাছে সাহায্য চাইবে তাদের পাশে দাঁড়াবে ভারত।

ভারতীয় সরকরের কর্মকর্তারা বলেছেন,  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠকে জানিয়েছেন ভারতীয়দের নিরাপত্তা দেওয়া শুধুমাত্র তাঁর লক্ষ্য নয় শিখ এবং হিন্দু সংখ্যালঘু শরণার্থীদের পাশাপাশি আফগান ভাইবোনদের পাশেও দাঁড়াবে ভারত।12

vocinter