তালিবানের চোখে চোখ রেখে, তাদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পরেছে শত শত আফগান দেশপ্রেমিক মেয়েরা। সদ্য আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে তালিবান। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তাদের নিত্যনতুন সন্ত্রাসের খবর শিরোনামে আসছে। শরিয়া আইন মেনে নারীদের সুরক্ষা, তাদের পড়তে ও কাজের সুযোগ দেয়া হবে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পরে আফগান কন্যাদের এই অভয়বাণী শুনিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে দাবি করেছিল তালিবানরা। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ঠিক তার উল্টোটাই। কোথাও মহিলা নিউজ অ্যাঙ্করকে অফিসে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, কোথাও ছাত্রীদের স্কুলে যেতে দিচ্ছে না তালিবানরা। গোড়ালি বের করে পোশাক পরলে ঘরে-বাইরে তালিবানী অত্যাচারের শিকার হতে হচ্ছে বহু আফগান-নারীকে। একজন নারী সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছেন আফগানিস্তানের মাটিতে সাংবাদিক ও তাঁদের পরিজনরা। এই ঘটনায় তাঁরা কতটা বিপদের মধ্যে রয়েছেন, এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। এছাড়া বিরোধীদের
খুঁজতেও এভাবেই বাড়ি বাড়ি ঢুকে খোঁজ চালাচ্ছে তালিবানরা। জাতিসঙ্ঘের একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর জন্য কাজ করা ব্যক্তিদেরই নিশানা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, কাবুল এয়ারপোর্টগামী প্রতিটি গাড়িতে চিরুনি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এক পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জঙ্গিরা কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে না পেলে তাঁর পরিজনদের নিশানা করছে। তারপর শরিয়ত আইন মেনে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।সাংবাদিকদের পাশাপাশি তালিবান শাসনে দেশের নারীরাও যে সুরক্ষিত নয় তা স্পষ্টত। এই নিয়ে বুধবার থেকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে অবস্থান-বিক্ষোভ করছেন আফগান মহিলারা। ঘটনাটি ঘটেছে আফগান নিউজ চ্যানেলের মহিলা অ্যাঙ্কর শবনম দওরানের সঙ্গে। আরটিএ পাস্তো টিভি চ্যানেলের ওই অ্যাঙ্করের অভিযোগ, তাঁকে অফিসে ঢুকতে দেয়নি তালিবান। বলা হয়েছে, দেশের শাসনক্ষমতার হস্তান্তর হওয়ার পর নিয়ম বদলে গিয়েছে। একটি ভিডিও বার্তায় শবনম বলেছেন, ‘রোজকার মতো আমার শিফ্টের সময় অফিসে গিয়েছিলাম। কিন্তু, আমাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বলাহয়েছে, এখন নিয়ম বদলে গিয়েছে। বাড়ি চলে যাও।’ একই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন ওই চ্যানেলেরই মহিলা সাংবাদিক খাদিজা। তিনি জানান, তাঁর মতো আরও অনেক মহিলাকেই বাড়ি থাকতে বলা হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী ৩১ আগস্টের আগে সরকার গড়বে না তালিবান। প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি পালিয়েছেন। দেশান্তরী উচ্চপদস্থ আরও বহু কর্তা, রাজনীতিক। ভাঙা মনোবল নিয়ে ধুঁকছে ‘নিধিরাম’ আফগান সেনা। তাই এই পরিস্থিতিতে তালিবানের চোখে চোখ রেখে রাস্তায় নেমেছেন স্বয়ং আফগান মহিলারাই। রীতিমতো অস্ত্রশস্ত্র হাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁরা বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করেছেন। অংশ নিচ্ছেন মুখোমুখি যুদ্ধেও। বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসেই তালিবানি সমস্ত আতঙ্ককে ভুলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল আফগান কণ্যাবাহিনী। এই দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে, ওই ভিডিওয়ে দেখা গেছে, কাবুলের রাস্তায় কালো, লাল ও সবুজ জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিলে নেতৃত্বে আফগান মহিলারা।তাঁদের মুখে তালিবান বিরোধী স্লোগান। অন্যান্য শহরেও বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন নারীরা। জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালিয়েছে জঙ্গিরা। মৃত্যু হয়েছে কয়েকজন আফগান কন্যার। কিন্তু, দমে যায়নি নারী যোদ্ধারা। ফলে ২৪ ঘণ্টার কার্ফু জারি করতে বাধ্য হয়েছিল তালিবান। অন্য ভাইরাল ভিডিওয়ে একদল মহিলাকে অত্যাধুনিক রাইফেল কাঁধে দেখা গিয়েছে। পঞ্জশির প্রদেশে তালিব-বিরোধী জোটেও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন নারীরা।১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালিবানি শাসনের ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়েছে আফগানরা। মানুষ বুঝতে শুরু করেছে, নিজেরা পালিয়ে গোটা দেশকে বাঁচাতে পারবে না। হয় তালিবানের কাছে আত্মসমর্পণ, নয় গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। তাই কাবুল দখলের চার-পাঁচ দিনের মধ্যেই বোধোদয় ঘটেছে শান্তিকামী আফগানদের। মরিয়া হয়েই রাস্তায় নেমেছেন। পুরুষ-মহিলাদেরমিলিত প্রতিরোধের মুখে শুক্রবারই বড় সাফল্য পেয়েছে আফগান যোদ্ধারা। তুমুল তাঁরা। সংঘর্ষের পর বাঘলান প্রদেশের পুল-ই-হেসার জেলা তালিবানের কবল থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’। শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী দেহ-ই-সালাহ ও বানু জেলাও জঙ্গিমুক্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এই সব সংঘর্ষে হতাহত হয়েছে অন্তত ৬০ জন তালিবন জঙ্গি।কাবুলের উত্তরে অবস্থিত পুল-ই-হেসার জেলার খুব কাছেই পঞ্জশির উপত্যকা। ইতিমধ্যেই এই পঞ্জশিরে তালিবান বাহিনীকে রুখে দিয়ে নজির গড়েছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স। প্রয়াত তালিবান বিরোধী নেতা তথা নর্দার্ন অ্যালায়েন্স-এর কমান্ডার আহমেদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমেদ মাসুদের নেতৃত্বে লড়ছে সাধারণ মানুষ। জানা গিয়েছে, আহমেদ মাসুদের সঙ্গে ইতিমধ্যেই বৈঠক করেছে তালিবান নেতৃত্ব। পরে একটি ভিডিও বার্তায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘আমাদের মাতৃভূমি এবং স্বাধীনতার উপর সমস্ত আঘাত আমরা যেকোন মূল্যে রুখবই।’
voc-12