আর কয়েকদিন পরই অনুষ্ঠিত হবে ঈদুল ফিতর। ঈদকে সানে রেখে পাইকারি ও খুচরা বিক্রির জন্য শাড়ি, প্যান্টসহ নানা পোশাকের বড় মাকের্ট বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেকসহ ৬ মার্কেট। কিন্তু মঙ্গলবার কাক ডাকা ভোর আগুন লেগে পুরো বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ধ্বংশ হয়ে যাবে এমনটা কেউ-ই বুঝে উঠতে পারেনি।
রাজধনী ঢাকার উপকন্ঠে বঙ্গবাজার বৃহত্তম পোশাকের মার্কেট যা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের জন্য কম মূল্যে পোশাক কেনার ভরসা স্থল ছিল।সুলভ মূল্যে পোশাক কেনার জন্য সব সময় বঙ্গবাজার সকাল থেকেই ক্রতা সাধারণের ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠতো। আসন্ন ঈদের কারণে তা আরও বৃদ্ধি পায়।সামনে মুসলিমদের প্রধান উৎসব ঈদ তাই পোশাকে ঠাসা ছিল বঙ্গবাজারের মজুদ। মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগর এবং এনেক্সকো (সিটি প্লাজা) শপিং কমপ্লেক্সসহ ৬টি মার্কেটে ভয়াবহ আগুনে নিঃস্ব হয়েছে ৫ হাজার ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ীর সঙ্গে কাজ হারিয়েছে ৫০ হাজার শ্রমিক। ৬ ঘণ্টার আগুনে চোখের সামনে পুড়ে ছাই হয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। ভস্মীভূত হয়েছে কমপক্ষে কয়েকশ’ কোটি টাকার পণ্য। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট, বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার, সেনাবাহিনীর প্রযুক্তি কোন কিছুই আগুন থেকে রক্ষা করতে পারেনি ৫টি মার্কেটের নিঃস্ব হওয়া ব্যবসায়ীদের বেঁচে থাকার সম্পদ। ঈদের বাজারে ঘিড়ে ব্যবসায়িদের আনেক স্বপ্ন থাকে।থাকে পরবার পরিজনদের জন্য নতুন- নতুন পরিকল্পনা, কিন্তু ভয়াবহ আগুন তাদের সেই স্বপ্ন পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। ব্যবসা তো দূরের কথা এখন ব্যবসায়ীদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।এদিন ভোর সোয়া ৬টায় আকস্মিক বঙ্গবাজার শপিং কমপেক্স থেকে আগুন লাগে। কিন্তু আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা আগুনের লেলিহান শিখা চোখের পলকে জীবনের শেষ সম্বল ছাই হতে দেখেছে ব্যবসায়ীরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আনতে ৬টি মার্কেটের আড়াই হাজারের বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই হয়েছে। বাকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আংশিক মালামালও পুড়েছে। বেলা ১২টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে প্রশাসন।
সরেজমিন দেখা গেছে, আগুন যখন লাগে ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের অনুরোধ করেছিল মার্কেট রক্ষা করার জন্য। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা এতটাই তীব্র ছিল যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দূর থেকে আগুন নেভাতে পানি দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।একদিকে আগুন নিভানোর চেষ্টা অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মালামাল রক্ষার লড়াই। ব্যবসায়ীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মার্কেট থেকে যে যার মতো মালামাল বের করার চেষ্টা করেন। কিছু কিছু ব্যবসায়ী মালামাল বের করতে পেরেছেন, আবার কোন ব্যবসায়ী কোন মালামালও রক্ষা করতে পারেননি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, চোখের সামনে তাদের সব শেষ হয়ে গেছে। তারা কোন মালামাল রক্ষা করতে পারেননি। ভোর ৬টার পর যখন আগুন লাগে তখন ব্যবসায়ীরা সবাই যে যার বাসায় অবস্থান করছিলেন। ফোনে আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে আসেন মালামাল রক্ষা করতে। কিন্তু এসেই
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, সোমবার সারাদিন মার্কেটে কোটি কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়েছে। রাতভর বেচাবিক্রি শেষে ব্যবসায়ীরা যে যার মতো মালামাল গুছিয়ে ফেলেন। অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ রেখে বাসায় চলে যান। কিন্তু সকালে আকস্মিক আগুন লাগার খবর পান। কোন মার্কেট থেকে কিভাবে আগুন লেগেছে তারা কিছুই জানেন না। ফায়ার সার্ভিসও বলছে, আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে তারা কোন ধারনা পাননি। কিভাবে আগুন লেগেছে সে বিষয়ে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস।
সরেজমিন কথা হয় অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। ব্যবসায়ীরা বলছেন তারা আগুন লাগার কারণ জানেন না। অধিকাংশের ধারণ বৈদ্যুতিক শটসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন এটি নাশকতাও হতে পারে। তবে মার্কেটটি অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ ছিল ফায়ার সার্ভিসের তালিকায়।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, আগুন লাগার কারণ এখনও জানা যায়নি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলেই আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আগুন লাগার পর অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালামাল বের করার চেষ্টা করছেন। তাদেরই একজন ব্যবসায়ী বেলায়েত হোসেন। পুড়ে যাওয়া মার্কেটে বেলালের ৬টি দোকান ছিল। ৬টি দোকানে শাড়ি ও লেহেঙ্গা মলিয়ে কোটি টাকার পণ্য তোলেন। আগুন লাগার পর কিছু মালামাল বের করে দোকানের সামনে রাখেন। কিন্তু সেগুলো সরিয়ে ফেলার আগে আগুনে মার্কেট ধসে পড়লে বের করে আনা মালামাল আর রক্ষা করতে পারেননি। সেভেন স্টার শাড়ি ঘরের মালিক বেলায়েত হোসেন ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলতে ঋণও নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। কিন্তু চোখের সামনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ী বেলায়েত হোসেন জানান, ঈদ উপলক্ষে পাইকারি ও খুচরা বিক্রির আশায় তিনি কোটি টাকার মালামাল তুলেছেন। কিন্তু কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। বেলায়েত হোসেনের মতো অনিক ফ্যাশনের মালিক আরিফ হোসেনের রয়েছে ৪টি দোকান। জিন্স প্যান্টের দোকানগুলোকে কোটি টাকার মালামাল ছিল। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখায় মালামাল রক্ষা করতে পারেননি। শুধু বেলায়েত হোসেনই নয় এই রকম বহু ব্যবসায়ী নি:স্ব হয়ে গেছেন।
আগুনের ঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তদন্ত করবে। অন্যদিকে ঢাকা দণি সিটি করপোরেশন ৮ সদস্যদের একটি কমিটি গঠন করেছে।
@ সোহরাব আলম, ঢাকা