বাংলাদেশের পাশে দাড়ানো ও প্রত্যাবর্তনের জন্য বিশ্ববাসীকে পদক্ষেপ নিতে হবে
এম এ রহিম
২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অপ্রতিরোধ্য বহির্গমণের পর থেকে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি নিয়ে বিরাট সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সন্মুখীন হতে হয়েছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে ১১ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের থাকা-খাওয়াসহসহ বিভিন্ন সাহায্য-সহয়তা অব্যাহত রেখেছে যা এখন বাংলাদেশের কাছে মারাত্বক বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়ানমার সরকারের অমানবিক ও অপ্রতিরোধ্য অত্যাচারের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা শরনার্থী হয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর জন্য এবং মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের জন্য যথেষ্ট পরিমান পদক্ষেপ নেয়নি।
তবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটি কর্তৃক সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একট প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। গত সপ্তাহে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সদস্যরা যৌথভাবে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা ওই প্রস্তাবে সবাই একমত হয়েছিল যে, বিশ্বকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়নো উচিৎ এবং রোহিঙ্গা জনগণ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতি মিয়ানমারের নিন্দনীয় আচরণের মোকাবিলা করা জরুরি। জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটির এই প্রস্তাবটি ভালো সংবাদ ও তা বেশ তাৎপর্যবহণকরে।
এই প্রস্তাবের কয়েকটির মধ্যে প্রথমটি হলো মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেশে ফেরার জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে তা নিশ্চিত করার জন্য একযোগে চাপ বাড়াতে হবে, তবে এটা নিশ্চিত করে না যে এই শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যে হেতু ওই রেজোলিউশনটিকে দ্রুত পদক্ষেপে পরিণত করার জন্য জাতিসংঘ এবং মানবিক সহায়তা গোষ্ঠী উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। উদ্বাস্তুরা শেষ পর্যন্ত এবং নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের এই বিপর্যয়ের সাথে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করা প্রয়োজন। যদিও শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টা উদারতার একটি স্তর প্রদর্শন করে যা বিশ্বের অন্য কেউ এখনও দেখাতে পারেনি, তাই বাংলাদেশের উপর চাপ কমাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বোঝা ভাগ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার কতা বলা হয়েছে এব এর জন্য এখনই সময়।
সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতির কথাও উঠে এসেছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) যৌথভাবে সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটির কাছে প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেছে। ১০৯টি দেশ এই রেজোলিউশনটির সহ-স্পন্সর করেছে, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ।
রোহিঙ্গা সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করার পাশাপাশি, রেজোলিউশনটিতে মিয়ানমারকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের মিয়ানমারে বিশেষ দূত সহ জাতিসংঘের সকল মানবাধিকার সংস্থাকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তা ছাড়া প্রস্তাবে “রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আইসিসি, আইআইএমএম এবং অন্যান্য জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের অব্যাহত সহযোগিতার প্রশংসা করা হয়েছে।” এইরেজুলেশনে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘দায়িত্ব ও বোঝা ভাগাভাগি’ নীতির অধীনে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে আঞ্চলিক দেশ ও আসিয়ানের মতো সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। আসিয়ান কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত পাঁচ দফা সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও সজাগ ও সচেতন হবে বলে আশা করা যায়। বলা যায়, ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজ তুলনামূলকভাবে সহজ হবে।
তার পরেও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরতে পারবে কি না সেটাই মূল প্রশ্ন। যতদিন এই লক্ষ্য অর্জিত না হবে ততদিন বাংলাদেশের জন্য স্বস্তি থাকবে না। অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং আর্থ-সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে।
কিন্তু এই মানবিক পদক্ষেপ এখন বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি হয়েছে বহুমাত্রিক সংকট। দূষিত হয়ে পড়েছে কক্সবাজার এলাকার পরিবেশ। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়েছে। রোহিঙ্গারা মাদক চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এই পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি।
এ বাস্তবতায় রোহিঙ্গা সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর এই সমাধান হতে পারে একমাত্র রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করা যাতে দেশটি তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও জোরালো ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।