b
বিপুল দাস
রাত পোহালেই হাই ভোল্টেজ উপ-নির্বাচন ভবানীপুর কেন্দ্রে। ভোট কেন্দ্রে কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে পুরো এলাকায় আঁটোসাঁতো নিরাপত্তার ব্যাবস্থা থাকবে, যা নিয়ে পুলিশি তৎপরতা তুঙ্গে। ভোটকেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে যাতে কোনও নিরাপত্তা রক্ষীর হাতেও যেন অস্ত্র না থাকে তা নিয়ে পুলিশকে কড়া নির্দেশ দিল লালবাজার। প্রত্যেকটি বুথেই থাকছে আধাসেনা।
পুরো নির্বাচনী এলাকায় টহলদারির জন্য থাকছে ২২টি সেক্টর মোবাইল, দিন ও রাতে ২৩টি করে আরটি মোবাইল, ন’টি করে হেভিরেডিও ফ্লাইং স্কোয়াড, ফ্লাইং স্কোয়াড, স্ট্যাটিক সার্ভাইলেন্স টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স। থাকছে ১৩টি কুইক রেসপন্স টিম, তিনটি ডিভিশন স্ট্রাইকিং ফোর্স। নিরাপত্তার নজরদারিতে রাস্তায় থাকবেন একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, চারজন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার, ১৪ জন করে ডেপুটি কমিশনার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পদমর্যাদার অফিসার। থাকছে তিনটি অতিরিক্ত কন্ট্রোলরুম, ৩৮টি পুলিশ পিকেট, ইভিএম এসকর্ট করার জন্য থাকছে ১৪১ টি গাড়ি। থাকছে দুটি স্ট্রং রুমও।
৩৫ কোম্পানি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সহ লালবাজারের আধিকারিকদের নজর ভবানীপুরের প্রতিটি কোনায়। সাধারণ মানুষের ভোটদানকে নির্বিঘ্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিচ্ছেন আধিকারিকরা। পুলিস সূত্রে খবর, বুধবারই এলাকায় পৌঁছে যাবেন জওয়ানরা। আগের দিন নয় ভোটগ্রহণের ২ দিন আগেই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে ভবানীপুরে। সাধারণত ভোটের আগের দিন সংশ্লিষ্ট এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ভবানীপুরের ক্ষেত্রে সেই নিয়মেরও ব্যতিক্রম ঘটল। কমিশন সূত্রে খবর, মঙ্গলবার সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা থেকে প্রত্যেকটি বুথ ও আশেপাশের এলাকায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। বৃহস্পতিবার সবকটি বুথে হবে ওয়েবকাস্টিং। এ ছাড়া পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ভোট শেষ হওয়া না পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে ৫ জনের বেশি কেউ জমায়েত হতে পারবে না বলে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রতি নির্বাচনেই শহরের অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় ভবানীপুরে ভোটদানের হার তুলনামূলকভাবে কম থাকে। ২০১১ সালে বাম ফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে তৃণমূল ক্ষমতা দখল করে যখন, সেই বছর ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী ছিলেন তৃণমূল নেতা সুব্রত বক্সী। ২০১১ সালে ভবানীপুরে ভোটদানের হার ছিল ৬৩.৭৮ শতাংশ এবং এর মধ্যে সুব্রত বক্সী পেয়েছিলেন ৮৭,৯০৩টি ভোট। দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাম প্রার্থীর সঙ্গে তার ভোটের ফারাক ছিল ৩৬.৮ শতাংশ। সরকার গঠনের পরে ভবানীপুরে উপ-নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু উপ-নির্বাচনে ভবানীপুরের আরও কম মানুষ বুথ-মুখি হন। উপনির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল মাত্র ৪৪.৭৩ শতাংশ। কয়েকমাস আগে হয়ে যাওয়া নির্বাচনের তুলনায় ১৯% কম মানুষ ভোট দেন ভবানীপুরের উপ-নির্বাচনে। যদিও এই ৪৪.৭৩ শতাংশ ভোটের সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৭৭.৪৬ শতাংশ ভোট পান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাম্ ফ্রন্ট প্রার্থী নন্দিনী মুখার্জি পেয়েছিলেন ২০.৪৩ শতাংশ ভোট। কম সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেও প্রায় ১২.৬৯ শতাংশ ভোট বৃদ্ধি পায় তৃণমূলের।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রার্থী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালের তুলনায় এই কেন্দ্রে ভোট দানের হার ৩.০৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও অন্যান্য কেন্দ্রের তুলনায় তা খুবই কম ছিল। ২০১৬ সালে ভবানীপুরে ভোটদানের হার ছিল ৬৬.৮৩ শতাংশ। এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬৫,৫২০ যা মোট ভোটের ৪৮.৫ শতাংশ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের দীপা দাশমুন্সি পেয়েছিলেন ৪০,২১৯টি ভোট। এই নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দীর প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য ছিল প্রায় ১৮.৭ শতাংশ।
২০২১ সালের নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুর কেন্দ্রের পরিবর্তে নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হন। ভবানীপুরে তৃণমূলের প্রার্থী ছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। এই নির্বাচনেও ভোটদানের হার আশানুরূপ ছিলনা। এই নির্বাচনে ভোটদানের হার ২০১১ সালের নির্বাচনের তুলনায় কমে দাঁড়ায় ৬১.৭২ শতাংশতে। এর মধ্যে ৫৮.৪ শতাংশ ভোট তৃণমূল পেলেও তৃণমূলের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি-র রুদ্রনীল ঘোষ পান ৩৫.৬ শতাংশ ভোট। ২২.৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয় তৃণমূল (TMC)।
ভবানীপুর কেন্দ্রে কলকাতা পৌরসভার ৮টি ওয়ার্ড আছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ভোটের ফল অনুযায়ী ৭৪ এবং ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩১ ভোট এবং ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে প্রায় ২০৯২ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তারা। অন্যদিকে BJP-র সঙ্গে তৃণমূলের ২৮,৭১৯ ভোটের যে ব্যবধানের তার মধ্যে প্রায় ২১,৭৭৯ ভোটে তারা এগিয়ে রয়েছে শুধু মাত্র ৭৭ নম্বর ওয়ার্ডে। অর্থাৎ বাকি ৫টি ওয়ার্ড মিলিয়ে মাত্র ৬,৯৪০ ভোট এগিয়ে রয়েছে তৃণমূল ।
ভবানীপুরে মোট ভোটার ২,০৬,৩৮৯ জন। এর মধ্যে ৯৫,১৪৩ জন মহিলা ভোটার। অর্থাৎ, মোট ভোটারের প্রায় ৪৬ শতাংশ মহিলা। ২০২১-এর নির্বাচনের হিসাবে মহিলারা বেশিমাত্রায় ভরসা রেখেছেন তৃণমূলের উপরে। এছাড়া তৃণমূলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভবানীপুর কেন্দ্রের প্রায় ২০ শতাংশ ভোটার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। এছাড়াও শিখ এবং অবাঙালি হিন্দু ভোটার মোট ভোটারের প্রায় ৩৪ শতাংশ।
বৃষ্টি -দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে মঙ্গলবারই বুথ এবং এজেন্টদের নিয়ে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে তৃণমূল। কর্মীদের তালিকা হাতে রেখে ১০০ শতাংশ ভোটারকে বুথে আনার টার্গেট নিয়ে মাঠে নামছে নেতৃত্ব। ভোটের প্রচার পর্বের সবটা শেষ হয়ে গিয়েছে সোমবারই। মঙ্গলবার একেবারে রুটিন বৈঠক করে নেতৃত্ব। সেখানে ৮টি ওয়ার্ডের প্রতিনিধি থেকে বুথ এজেন্টদের দফায় দফায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের কি করণীয়। তাদের ভোট ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে। ৭০ এবং ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে গত বিধানসভা ভোটে পিছিয়ে ছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ও। সেই দু’টি ওয়ার্ডেও এবার বেশি ভোট টানার টার্গেট নিয়েছে তৃণমূল। উপনির্বাচনে সাধারণত ভোট কম পড়ে। সে কথা মাথায় রেখেই ভোটারদের বুথকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করার লক্ষ্য রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রী ও কলকাতা পৌর কর্পোরেশন মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন মমতা ব্যানার্জী নির্বাচনে ব্যাপকপরিমান ভোটে জয়লাভ করবে। কারণ বাংলার মেয়ে, ভবানীপরের ঘরের মেযে মমতাকে বাংলার মানুষ কতটা ভালোবাসে তা গত বিধানসভা নির্বাচনে তরা দেখিয়ে দিয়েছে।তিনি বলেন, নির্বাচনে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে তৃণমূল তা প্রতিহত করবে।
বিজেপি ও সিপিএম-র প্রার্থীরাও নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছে। এই দুটি দলেরই অভিযোগ মমতা বন্দোপাধ্যায়ের খাসতালুক ভবানীপুরে অন্যকোন বিরোধী দলকে প্রচার করতে দেয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনের অনুমতি থাকা সত্বেও ভবানীপুরের বেশ কয়েকটি এলাকায় হাই সিকিউরিটি জোন দেখিয়ে পুলিশ তাদরে ঢুকতেই দেয়নি। প্রচার করতে গিয়েও পুলিশি হেনেস্তয় পড়তে হয়েছে তাদের। বিরোধীদের ৫০ শতাংস প্রচার করতে দেয়নি পুলিশ।