প্রণব ভট্রাচার্য্য

কলকাতা :  অবশেষে মমতার আত্মপ্রত্যয়ের উপরই আস্থা রেখেছেন ভবানীপুরের ভোটাররা। রেকর্ড পরিমান ভোট দিয়ে ভবানিপুরবাসী তৃতীয়বারের মত বিধায়ক করেছেন ঘরের মেয়েকে। ৫৮ হাজার ৩৩২ ভোটের ব্যবধানে নিজের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি বিজেপির প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে বিরাট মার্জিনে পরাজিত করে নিজের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন সকালে ভোট গণনার শুরু হওয়ার পর থেকেই একেরপর এক তাঁর ভোটের ব্যাবধান বাড়তে থাকে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে খবর, পোস্টাল ব্যালট নিয়ে মোট ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন মমতা। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল পেয়েছেন ২৬ হাজার ৩২০ টি ভোট। অন্যদিকে সিপিএমের শ্রীজীব বিশ্বাস পেয়েছেন ৪ হাজার ২০১টি ভোট। ভবানীপুরে এই বিরাট ব্যবধানে এর আগে কেউ জয় পাননি। এর আগে বিরাট ব্যবধানে ভবানীপুরে জয়ের রেকর্ড ছিল মমতার ঝুলিতেই। ২০১১ সালে পালাবদলের বছরে উপনির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। সেবার তাঁর ব্যবধান ছিল ৫৪ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু এ বার সেই ব্যবধানকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।

২১ রাউন্ড গণনা শেষে তৃণমূল প্রার্থী মমতা মোট ভোট  পেয়েছেন ৮৪ হাজার ৩৮৯ টি। বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল পেয়েছেন ২৬ হাজার ৩২০ ভোট। শেষ পর্যন্ত  সিপিএম প্রার্থী শ্রীজীব বিশ্বাস পেয়েছেন ৪২০১ ভোট। ৫৮ হাজার ৮৩২ ভোটে জয়ী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জয়ের পর থেকেই তৃণমূল শিবিরে শুরু হয়েছে বিজয় উৎসব।

অন্যদিকে, ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরই ক্ষোভে রীতিমতো ফেটে পড়েন বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। তিনি হতাশ। তার বিস্ফোরক অভিযোগ, “সব ওয়ার্ডে রিগিং হয়েছে।”  হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকেও তিনি যে লিড ন পাননি, সেটাও চেপে রাখেননি তিনি। ফল ঘোষণা হওয়ার পরই সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে প্রিয়াঙ্কা বলেন, “ভোটের দিন কী ভাবে রিগিং করতে হয় সেটা আপনাদের মাধ্যমেই দেখেছি। তাই ওদের রিগিং করে, ছাপ্পা ভোট মেরে জেতার জন্য শুভেচ্ছা জানাই।” কোথায় কোথায় রিগিং হয়েছে? প্রশ্ন করায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, “সবকটা ওয়ার্ডেই রিগিং ও ছাপ্পা ভোট পড়েছে।” কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়েকে হারাতে যেভাবে দিদি পুরো মন্ত্রিসভাসহ রাজ্য প্রশাসন,  পুরো  পুলিশ প্রশাসন ও নিজস্ব ক্যাডার ব্যাবহার করেছেন তার জন্য আমি খুব খুশি।”

ভবানীপুরে এতদিন যা বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল, সেখানেই এ বার হানা দিল তৃণমূল। ৮টি ওয়ার্ডের  বিচিত্র এই বিধানসভা কেন্দ্রে ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে গণনার শেষে দেখা যায়, সেখান থেকে ১৫৫৬ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৭০ নম্বর ওয়ার্ডের এই ফলাফল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, এই ওয়ার্ড পুরোপুরি অবাঙালি অধ্যুষিত। তাই  ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রকে বলা হয় ‘মিনি ভারতবর্ষ’। কারণ, গোটা ভারতে যে ধরনের ভাষাভাষি মানুষদের বাবাসের বৈচিত্র দেখা যায়, ঠিক একই ধরনের বৈচিত্র রয়েছে ভবানীপুরেও। এখানে বাঙালি হিন্দু ভোটারদের হার ৪২ শতাংশ। অবাঙালি হিন্দু রয়েছেন ৩৪ শতাংশ। সংখ্যালঘু  মুসলিম ভোটার হার ২৪ শতাংশ।

বিজেপিকে বড় ধাক্কা দিয়েছে ভবানীপুরের ৬৩ নম্বর, ৭৪ নম্বর ও ৭১ নম্বর ওয়ার্ড। ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডে অবাঙালি আধিপত্য বেশি। মোট ভোটারদের মধ্যে ৫০ শতাংশ এই ওয়ার্ডে অবাঙালি। ২০১৪ সাল থেকে মাত্র একবার ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে লিড নিতে পেরেছিল বিজেপি। সেটা ২০১৬ সালে। তার পর যতবার ভোট হয়েছে, ততবার বিজেপিই এগিয়ে থেকেছে। কিন্তু এ বার সেই ট্রেন্ড উল্টে গেল। ভবানীপুরের ৭১ নম্বর ওয়ার্ডে লোকসভা ভোটে বিজেপি এগিয়ে থাকত। কিন্তু সেখানেও এ বার লিড নিয়েছেন মমতা। অর্থাৎ যে যে কেন্দ্রগুলি ঘিরে বিজেপি জয়ের আশা করেছিল, সেই ওয়ার্ডগুলিই গেরুয়া শিবিরকে ধাক্কা দিয়েছে ব্যাপক ভাবে।ভবানীপুরে  ভোটের অবস্থা এই  হবে সে ব্যাপারে রাজনৈতিক মহলও বুঝতে পারেনি। মমতা যে এই উপ-নির্বাচনে জিতবেন তা নিশ্চিত ভেবেছিলেন রাজ্য রাজনীতিবিদরা। কিন্তু ব্যাবধান বিরাট ব্যবধানে বিজেপি ও সিপিএম কার্যত মুখ থুবড়ে পড়বে মমতা ম্যাজিকের সামনে তা বুঝতে পারেননি, এমনটাই বলেছেন কলকাতা বিশ্ববিধ্যালয়ের রাষ্ট্রবিঙাণ-র প্রফেসর বিশ্বাস। তিনি বলেন, ভোট পরবর্তী হিংসা মামলায় সাফল্য পাবার পর দাপুটে আইনজীবী তথা মহিলা মুখ প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালের ওপর ভরসা রেখেছিল বিজেপি। আট বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রিয়াঙ্কা জোরদার লড়ার চেষ্টা করেছিলেন এ কথা সত্যি তবে সে লড়াই একেবারেই কাজে এল না।

বিশাল জয়ের পর মমতা বন্দোপাধা্যয় ভবানীপুর বাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘‌ভবানীপুর বিজেপিকে জব্দ করে দিয়েছে। ভবানীপুর আমাকে আরও কাজ করার প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি চিরঋণী। ভবানীপুরের সব মা ভাই বোনেদের কাছে। ভবানীপুরে উপনির্বাচনে এবার ১ লক্ষ ১৫ হাজারের মতো ভোট পড়েছিল। সেই তুলনায় সামশেরগঞ্জ ও জঙ্গিপুরে ভোট পড়েছিল অনেক বেশি। ২০১১ সালে আমি ভবানীপুরে ৫৪ হাজার ভোটে জিতেছিলাম। গত বিধানসভা নির্বাচনে ভবানীপুরে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ২৮ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। এবার আমরা ৫৮ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছি। ভবানীপুরবাসীকে অভিনন্দন। ভবানীপুর বিধানসভার অন্তর্গত কোনও ওয়ার্ডে এবার হারিনি।

মমতা ব্যানার্জি আরও বলেন, ‘‌পুজোর পরই শান্তিপুর, খড়দহ, গোসাবা, দিনহাটায় উপনির্বাচন রয়েছে। শান্তিপুরে তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন ব্রজকিশোর গোস্বামী। দিনহাটায় তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন উদয়ন গুহ। খড়দহে তৃণমূল প্রার্থী হচ্ছেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। গোসাবার জন্য দুটি নাম ভাবা হয়েছে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি কাকে প্রার্থী করা হবে। ৩০ অক্টোবর ওই চারটি কেন্দ্রে উপনির্বাচন হবে।

বিজেপির এই উপনির্বাচনে এই খারাপ রেজাল্ট করার পেছেনে অনেক গুলো ফ্যাক্টর কাজ করেছে তার মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু, মুসলিম সংখ্যালঘুর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করাটাই ছিল মূল, এমনটাই বলেছেন রাজনৈতি বিশ্লেষক অরিন্দম সিনহা রায়। বিধান সভা ভোটের আগেও বিজেপিকে বঙালি বিরোধী ও বহিরাগত, এবং সংখ্যালগুদের কাছে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ দল হিসেবে প্রচার করে আসছে তৃনমুল। বিজেপি আস্তে আস্তে পিছিয় য়াচ্ছে। কারণ, ‘আমরা বাঙালি দল নই, আমরা আবাঙালির দল’ কিন্তু তারা বাঙালি-আবাঙালি-সংখ্যালঘু তথা  সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী শক্তিশালী দল, এই বি্যয়টিকে পস্চিম বঙ্গ-র বাঙলিদের মাঝে বুঝাতে পারছেনা। তারা বাঙালি বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে যতটা না, তার চেয়ে বেশী তাদেরকে বাঙালি বিরোধী দল বলে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে তৃনমুল বিজেপিকে কোনঠাসা করেছে। বিজেপির বাংলার নেতৃত্ব তারা যে বাঙালি বিরোধী নয়, এই বিষয়টিকে বাঙালি সেন্টমেন্টকে তা প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যার্থ হুয়েছেন।

বিশ্লেষক অরিন্দম সিনাহ বলেন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাঝে মাঝে কিছু ভূল সি্দ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার কারণে রাজ্য বিজেপির  আন্দরে অসন্তো্য কাজ করে। হঠাৎ করে এই সব সিদ্ধান রাজ্য রাজনীতিতে আসনি সংকেট হয়। সদ্য দুটি কারণ হিসেবে তিন উল্লেখ করেছেন, এই উপ-নির্বাচনের সন্ধিক্ষণে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষকে  সভাপতির পদ পরিবর্তন করে সেখানে উত্তরাঞ্চলের সাংসদ ড. সুকান্ত মজুমদারকে দানা হয়েছে। আরিন্দম সিনহার বক্তব্য, পরিবর্তন দলের প্রয়োজন হতে পারে কিন্তু নির্বাচন সমগত কালিন কেন করা হলো বোদগম্য নয়। দিলীপ ঘো্য তার নেতৃত্ব দিয়ে একটানা সাত বছর দলটিকে বাংলায় একটি ভালো পর্য়য়ে এনে দিয়েছেন। একদা দুই থেকে ১৮ সাংসদ ও তিন থেকে ৭৭ বিধায়ক হওয়াটা তার নেতৃত্ব কালিন হয়েছে। তৃণমূলের কাছে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্ব গুরুত্ব ছিল। ভবানীপুরে বাঙালি আবালীর কাছেও বিষয়টি বেস রেখাপাত করেছে।

এ ব্যাপারে বিজেপি সভাপতি ড. সকান্ত মজুমদারে কাছে জানত চেয়েছিলাম এই বিপর্যয়ের ব্যাপারে, তিনি বলেছেন, নির্বাচনে সাফল্যের আশা নিয়ে লড়তে হয়। কিন্তু ক্রমাগত মিথ্যাচার করে তৃণমূল বিজেপিকে বাংলায় বঙালি বিরোধী ও সাম্প্রদায়ক দল হিসেবে বলে বাংলাকে সর্বনাষের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা আমাদের এই পরাজয় ব্যাপারে সন্মিলিত ভাবে বিস্লেষণ করবো।

সুকান্ত মজুমদার বলেন, আমরা বাঙলি-অবাঙালি, বিহারী-হিন্দুস্তানি বা মুসলিম সংখ্যালঘু বিরোদী এই দরণের উগ্রপ্রাদেসিকতাবাদে আমরা বিশ্বাস করিনা।আমরা মনে করি ভারত সকলের। বাংলা যতখানি বঙালির ততখানিই কয়েকসো বছর ধরে এখানে বসবসকারী আন্য প্রদেশ বা রাজ্যের মানু্যও বাংলার। আবার গুজরাত যতটা গুজরাতির ততোটাই বাঙালির। গোয়া য়তটা গোয়ানিজের ততোটাই বাঙালির। বাংলায় কেউ এলে তাদেরকে বহিরাগত তকমা দেয়া হয় তৃনমুলী প্রচারে। এমনকি আমাদের ভবানীপুরের প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেয়ালকেও বহিরাগত বলে প্রচার করেছে তৃণমুল। অথচ তার জন্ম ভবানী পুরেই। মমতা যেমন ভবানীপুরের মেয়ে তেমনি প্রিয়াঙ্কাও ভবানী পুর ঘরের মেয়ে।