এম এ রহিম

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আরও একটি নতুন মাইল ফলক সৃষ্টি হতে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ভারতের উত্তরপ্রদেশ থেকে আসাম পর্যন্ত নদীপথে বিলাসবহুল প্রমোদতরী চালানো শুরু করতে যাচ্ছে ভারত।

সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের ১০ জানুয়ারি থেকেই ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসী থেকে রিভার ক্রুজের (বিলাসবহুল প্রমোদতরী) যাত্রা শুরু হতে চলেছে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ দিনের যাত্রা পথে বারাণসী থেকে বাংলাদেশ হয়ে আসামের ডিব্রুগড় পর্যন্ত পাড়ি দেবে এই প্রমোদতরণী।

প্রকল্পটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেলে এটিই হবে বিশ্বের দীর্ঘতম যাত্রা পথের বিলাসবহুল ক্রুজ। সেক্ষেত্রে এর জন্য ভারত অভ্যন্তরীণ জলপথ উন্নয়নে ও পর্যটনের মানচিত্রে নতুন দিগন্ত আনতে পারে বলে মনে করছে ভারত সরকার।

জানা গেছে, বারাণসী থেকে ১০ জানুয়ারি এই প্রমোদতরণী যাত্রা শুরু করবে। দীর্ঘ চার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে এই ক্রুজ। গোটা যাত্রাপথ সম্পূর্ণ করতে সময় লাগবে প্রায় ৫০ দিন। এই সফরে প্রায় ২৭টি নদী প্রণালির মধ্যে দিয়ে যাবে এবং যাত্রাপথে ৫০টিরও বেশি স্টপেজে দাঁড়াবে এই ক্রুজটি। যার মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন ডেল্টা, গঙ্গা আরতি, আসামের মায়ংয়ের কালো জাদু এবং কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানের মতো পার্ক।

দিন তিনেক আগেই বারাণসীর রবিদাস ঘাটে এই যাত্রার সময়সারণি প্রকাশ করেন কেন্দ্রীয় জাহাজ ও নৌপরিবহন মন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।

১০ জানুয়ারি থেকে এই ক্রুজটি তার যাত্রা শুরু করে গাজীপুর-বক্সার হয়ে ১৭ জানুয়ারি বিহারের পাটনায় পৌঁছাবে। এরপর বৌদ্ধগয়া-নালন্দা-ফারাক্কা-মুর্শিদাবাদ হয়ে ২৯ জুন কলকাতায় পৌঁছাবে। একদিন বিরতি নিয়ে পরদিনই পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অংশের নামখানা-সজনেখালি হয়ে তা সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করবে। পরে সেটি মোংলা বন্দর-বাগেরহাট-মোড়েলগঞ্জ-বরিশাল-সোনারগাঁও হয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌঁছাবে। এরপর আরিচা-টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ-চিলমারী-আসামের ধুবরি-গোয়ালপাড়া হয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি গোয়াহাটিতে পৌঁছাবে। পরে তা ২৬ ফেব্রুয়ারি মাজুলী আইল্যান্ড পৌঁছাবে এবং ১ মার্চ আসামের ডিগ্ৰুগড়ে গিয়ে তার যাত্রা শেষ করবে। বিলাসবহুল এই ক্রুজটি বাংলাদেশে ১৫ দিন অবস্থান করবে এবং এইসময় বাংলাদেশে ১,১০০ কিলোমিটার যাত্রা পথ অতিক্রম করবে।

৫০ দিনের দীর্ঘ এই ভ্রমণে বিনোদনের জন্য থাকছে সংগীত এবং সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শরিরের ফিটনেস ঠিক রাখার জন্য জিমের সুযোগ সুবিধাও থাকছে।

সরকারি ও বেসরকারি যৌথ ব্যবস্থাপনা মডেলের (পিপি মডেল) ওপর ভিত্তি করি চালানো হবে বারাণসী-বাংলাদেশ-ডিব্রুগড় এই প্রমোদতরণী। এই সফরের জন্য সরকারের তরফ থেকে ইতিমধ্যে  ‘ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ (আইডব্লিউএআই)-এর দুই জনপ্রিয় ক্রুজ সংস্থা অন্তরা লাক্সারি রিভার এবং জেএমবক্সী রিভার ক্রুজের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যদিও এই ৫০ দিনের ভ্রমণ যাত্রার জন্য টিকেট মূল্য কত হবে তা এখনো ধার্য করা হয়নি। কেন্দ্রের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই অপারেটররাই লাভ খরচের ভিত্তিতে টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করবে বলে জানা যায়।

এই ক্রুজের (প্রমদ তরণীর)  দৈর্ঘ্য হবে ৬২.৫ মিটার, প্রস্থ ১২.৮ মিটার। এতে ১৮টি স্যুট থাকবে। থাকবে এলইডি টিভি, স্মোক ডিটেক্টর লাইফ জ্যাকেট, ফ্রেঞ্চ ব্যালকনি, ৪০ আসনবিশিষ্ট রেস্তোরাঁ, স্পা, সানডেক ইত্যাদি। এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ হবে এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি প্রস্তুত করা হয়েছে।

এই রোমাঞ্চকর রিভারক্রুজ যাত্রার সময়-সারণি প্রকাশ করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানান, এই ক্রুজ ভ্রমণে আশ্চর্যজনক অ্যাডভেঞ্চার থাকবে।

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় জাহাজ ও নৌপরিবহন মন্ত্রী সর্বানন্দ সানোয়াল জানিয়েছেন, ‘গঙ্গা বিলাস’ নামক এই ক্রুজ বারাণসী থেকে ডিব্রুগড় পর্যন্ত ৫০ দিনের দীর্ঘতম নদী যাত্রায় ২৭টি নদী প্রণালীর ভিতর দিয়ে যাবে এবং ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থানসহ ৫০টিরও বেশি পর্যটন স্থান পরিদর্শন করবে। এটি হবে গোটা বিশ্বে একটি জাহাজেই বৃহত্তম একক নদী যাত্রা এবং এটি ভারত ও বাংলাদেশ উভয়কেই বিশ্বের রিভারক্রুজ মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ক্রুজ পরিষেবাসহ উপকূলীয় এবং নৌপরিবহনের উন্নয়ন সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার এবং দেশের বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এই অঞ্চলে এ জাতীয় আরও পরিষেবা চালু করা হবে। নদীতে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি, অভ্যন্তরীণ নৌপথ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বাণিজ্য ও পণ্যবাহী পরিষেবাকে সহজতর করবে এবং এর রুটের আশপাশের এলাকার পর্যটনকে উৎসাহিত করবে।’

সনোয়াল আরও জানান, ‘ক্রুজগুলো বিভিন্ন ধরনের হয়। আবার পর্যটকরাও বিভিন্ন মানসিকতা নিয়ে আসেন। কেউ কেউ সম্পূর্ণ ভ্রমণের জন্য থাকতে চান, আবার কেউ কেউ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারেন। এই পরিষেবাটি সব ধরনের পর্যটকদের সুবিধা দেবে।’ তিনি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ প্রোটোকল রুট ইতোমধ্যেই গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে দুই দেশকে সংযোগকারী বাণিজ্য ও ট্রানজিট চ্যানেল উন্মুক্ত করে দিয়েছে’।

বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মতিয়ার রহমান ও ব্যাবসায়ি সংশ্লিষ্টরা জানান.উত্তরপ্রদেশের বারাণসী থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আসামের ডিব্রুগড় পর্যন্ত বিশ্বের দীর্ঘতম বিলাসবহুল নদী ক্রুজ বা প্রমোদতরণী চালানোর যে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে ভারত সরকার যা ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়নকে আরও একটি মাত্রায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।