কবিতা গুচ্ছ–
বিপুল কৃষ্ণ দাস
ঘরে ফেরা :-
য়ুদ্ধ শেষে আমরা আবার ফিরে এসেছি ঘরে।
জয়বাংলায়।
আমাদের পোড়া দালানবাড়ি শুনসান।
ঝলসানো আসবাবপত্র, টিনের বাক্স-পোড়া কাঠ,
ভাঙ্গা সিন্দুক, ছড়ানো চারিদিকে।
অজস্র ফুল ফুটে আছে জবা গাছটায়!
আমার প্রিয় পুতুলটা খুঁজে পেলাম,
ধূলোমাখা ছেঁড়া পুটলীর মতো পরে আছে।
পোড়া দলিলপত্র ভাঙ্গাচোরা ইট-কাঠের স্তূপ
একাকার হয়ে আছে চারিদিক।
অক্ষত ছিলো দিদি শাশুড়ি আমলের শিলনোড়াটা।
মা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছিল
বুকফাঁটা সেই কান্নায় ভেসে গেল
পিতামহীর সংসার ত্যাজারতি ।
বাবা বসে রইল ঠাকু্র্দ্দা-ঠাকুমার চিতাভষ্মের পাশে।
আমাদের পুরনো ভৃত্য মেহের আলীকে কারা যেনো
নিয়ে গিয়েছিল কবরস্থানে।
শুইয়ে দিয়েছিল অন্তিম শয্যায়।
ঠাকু্র্দ্দা-ঠাকুমা আর মেহের আলীর
নৃশংস মৃত্যু সংবাদ আমরা শুনেছিলাম
সীমান্তের ওপাড়ে- শ…
বৃষ্টি ভেজা পোর্ট্রেট :-
এ গলিটা গেছে ওই রাস্তার মোড়ে
চুমো খায় ও গলির ঠোঁটে,
বৃষ্টি হঠাৎ নির্জন করে দেয় পথ
দু’গলির বুক শিহরণে কেঁপে ওঠে।
এ পাড়ার মাঠ বৃষ্টিতে ভিজে সারাদিন
ও পাড়ার গাছ জলছবি আঁকে,
চুলের বেনুনি খুলে কিশোরী লতা
ভেজা পোর্ট্রেট হয়ে বসে থাকে।
পাখির ডানায় হাওয়া, ঝাপিয়ে নামে বৃষ্টি
দেবদারু মেঘ থাকে আকাশে;
বৃষ্টি ভেজা ক্যানভাসে লেখা নিমন্ত্রনের চিঠি
ওড়না ওড়ানো বাতাসে।
এ গলির বুকে ডাকে ফের গর্ভবতী মেঘ
ও গলিতে জমা বৃষ্টির জল,
এ পাড়া ও পাড়া, ভিজে দু’গলি হয় এক
আদিগন্ত ভিজা সবুজ শাড়ির আঁচল।
কি করেযাই বলো?
যেতে তো হবেই একদিন, কি করে যাই বলো?
ডালিম গাছটায় অজস্র ফুল ফুটেছে
কিশোরী চুলের বেনুনিতে ঝুলছে লাল ফিতে।
বেলী ফুলের ঝোঁপ, জুঁইয়ের লতা একদিন স্পর্শ না পেলে
মুখ ভার করে থাকে।
স্টোর রুমের প্যাকিং বাক্সে তিনখানা বেড়াল শাবক,
মিটমিটিয়ে তাকায়, সাদা পশমে ঢাকা স্নেহের চাদর;
উঠোনে চড়াই-শালিখ দানাপানি খুঁটে খায়।
পাখির চোখ নিয়ে ওদের দেখি। ঘোর কাটেনা যেন,
খস্ খসে পাতার ফাঁকে টুনটুনির ছোট্ট বাসা।
কি করে যাই বলো?
নরম তুলোর সেই ছোট্ট বাসায় আমার মায়াময় জগত-সংসার।
কি করে যাই বলো?
বৃষ্টির গান ফেলে, মাছরাঙা শৈশব ফেলে,
শিউলী-বকুলের গন্ধ ফেলে,
ঝড়ের রাত, বনজোৎস্নার প্লাবন,
চিরচেনা পথ ধরে বাড়ি ফেরা;
স্বপ্নবোঝাই সিন্দুকের চাবি ফেলে, কি করে যাই বলো?
কি করে যাই বলো?
গরম চা’য়ের কাপে দড়ি পাকানো ধোঁয়া;
তোমার চোখের তারায়, শাড়ির ভাঁজে,
কপালে জমে থাকা বিন্…
চাকা :-
প্রবল বেগে ছুটছে সময়
ঘুরছে চাকা ঘুরছে-
হাত বদলের চতুর খেলায়
ভাঙছে আবার জুড়ছে।
ছুটছে সময় ছুটছে স্রোত
ক্ষিপ্ত ঘোরা ছুটছে;
পা মেলাতে তার পেছনে
নাভিঃশ্বাসও উঠছে।
কাল শুষে নেয় সবটুকু জেদ;
তাবৎ জীবন ঘিরছে।
শক্ত ঘাটি শক্ত গেরো
কঠিন দাঁতে ছিঁড়ছে।
পাহাড় সমান দম্ভ ভেঙ্গে
পায়ের তলায় ঠেকছে।
ঘুরছে চাকা ঘুরছে সময়
পাখির চোখে দেখছে।
এক মাঘে শীত যায় না জেনেও
ক্ষমতার ভুত চাপছে
ভাবীকালের শীত যে খাঁচায়
সময়টাকে মাপছে।
লাশ হয় কেউ, খুলছে কপাল
কারো কপাল পুড়ছে ,
অঢেল ধনের ভার কাঁধে নেই
বাঁশপাতাটা উড়ছে।
জলের সিঁড়িতে মা :-
জলের সিঁড়ি বেয়ে গাছের শীতল ছায়ায়
নেমে আসে দু’টো মায়াবী চোখ।
ঘোমটার ফাঁকে বরফগলা একখানা ঝলসানো মুখ।
আকাশের আঁচলে আল্পনা আঁকা সংসার-তেজারতি;
কার যেন নগ্ন পায়ের ছাপ।
লক্ষ্মী পেঁচার মত ডানা গুটিয়ে বসে আছে
খরতাপে ক্লান্ত এক নির্জন দুপুর।
পুকুর ঘাটে আমার লোকান্তরিত মা;
সংসারের সমস্ত ঝুল্-কালি ঝেড়ে মুছে মুছে ক্লান্ত।
খেয়া ঘাটে গাঙচিল ওড়ে, পারের অপেক্ষায়-
বাবার আঙুল ধরে মায়ের আঁচল ঘেঁসে
দাঁড়িয়ে আছে এক দুরন্ত, সুবোধ বালক হয়ে।
মামাবাড়ির পথটা খুব দীর্ঘ হয় ভালবাসা পেলে,
সে পথ ফুরোয় না যেন ছেলেবেলা কেটে গেলেও।
ডিমের খোলস ছেড়ে রূপথার ছানা;
আঁচলের আশ্রয়ে রাতের ঝিঁঝিপোকা,
দেবদারু গাছের মাথায় চাঁদ; ফিরে দেখি আমার মা,
আমার লোকান্তরিত মায়ের গন্ধ সারাবাড়িময়;
তালের পাখার তলায় শুয়ে আছে তাঁরা ভরা রাত।
আকাশের মেঘ ছেড়ে ধূধূ পথ ভেঙ্গে ভেঙ্গে নেমে আসে
জলের সিঁড়ি
ঠাকুমার ভাঙ্গা চশমার ফ্রেমে ক’ফোটা নোনা জল,
পুরনো সুটকেসে মামাবাড়ির ইতিহাস নিয়ে
ফিরে আসে মা।
লক্ষ্মীর পাঁচালিতে বাঁধা ঘর। লোকান্তরিত মা আমার
বহুকাল পরে ঘরে ফিরে আসে যেন
এই আলো-আঁধারিতে, জল সিঁড়ি পথ ধরে।
(কবি পরিচিতি: শিক্ষক, কবি ও ছড়াকার)।
ভিওসি কবি-