ঢাকা থেকে হরলাল রায় সাগর

বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমায় সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর ফের পাহাড়ি দল কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) হামলায় সেনাবাহিনীর দুই সৈনিক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন দুই কর্মকর্তা। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, মঙ্গলবার দুপুরে রুমা উপজেলার সুংসুংপাড়া সেনা ক্যাম্পের আওতাধীন জারুলছড়িপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এর আগেও গত মার্চ মাসেও বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে বোম পার্টি নামে পরিচিত সন্ত্রাসী গ্রুপ কেএনফের গুলিতে সেনা বাহিনীর টহল দলের এক সদস্য নিহত হন। ওই ঘটনায় আরও দুইজন আহত হন।

আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কেএনএ-এর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের আস্তানার খবর পেয়ে সুংসুংপাড়া আর্মি ক্যাম্প থেকে মেজর মনোয়ারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি টহল দল মঙ্গলবার (১৯ মে) ওই এলাকায় রওনা হয়। টহল দলটি জারুলছড়ি পাড়ার কাছে পানির ছড়ার কাছাকাছি পৌঁছালে দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সন্ত্রাসীদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ এবং অতর্কিত গুলিবর্ষণের মধ্যে পড়ে। এতে দুইজন অফিসার ও দুই জন সৈনিক আহত হয়। আহতদের হেলিকপ্টারের মাধ্যমে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত সৈনিক দুজনের মৃত্যু হয়। আহত দুই অফিসার চট্টগ্রাম সিএমএইচএ চিকিৎসাধীন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে আইএসপিআর। তবে হতাহতদের কারও নাম-পরিচয় ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার গহীন অরণ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। দেশমাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদ সেনাসদস্যদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুতে সেনাবাহিনী প্রধান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।

সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি পাহাড়িদের কাছে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত। সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে গত বছরের অক্টোবরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ওই সময় থেকে ধারাবাহিক অভিযানে বিভিন্ন সময়ে ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ এবং ‘বম পার্টি’র অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়।

পাহাড়িরা কেএনএফ সংগঠনটিকে ‘বম পার্টি’ নামে চেনে। তাদের সক্রিয় হওয়ার খবর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও রয়েছে। তবে দলটির সংগঠকরা এখনও অধরা। জুম্ম জাতীয়তাবাদী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (এমএন লারমা) গঠিত জনসংহতি সমিতি ভেঙে কয়েকটি দলের সক্রিয়তা রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। তার মধ্যেই কেএনএফের সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। কেএনএফ নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলের অনগ্রসর জনজাতিগুলোর ‘প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে তুলে ধরছে। তারা ‘কুকি-চিন রাজ্যে’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চাইছে; যেখানে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা থাকবে না, থাকবে বম, খিয়াং, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি ও ম্রোরা।

কেএনএফের নামে পরিচালিত ফেইসবুক পাতা ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এটি খোলা হয়েছে। এখানে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পোস্ট দেওয়া হয়। ফেইসবুক পাতায় সংগঠনটির প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে; যদিও তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।

নানা সূত্রে জানা যায়, এই নাথান বমের পুরো নাম নাথান লনচেও বম। বান্দরবানের রুমা উপজেলার এডেন পাড়ার বাসিন্দা তিনি। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে।

ছাত্রজীবনে জনসংহতি সমিতি সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে যুক্ত ছিলেন নাথান। পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর খাগড়াছড়ি শহরের মহাজনপাড়া এলাকার লারমা স্কয়ারে এম এন লারমার একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন সহশিল্পী নিম্মী দেওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে। তখন হিল আর্টিস্টস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। নাথানদের নির্মিত লারমার আবক্ষ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয় ২০০০ সালে। এরপর শিল্পী হিসেবে তার খ্যাতি বাড়ে। তিনি লেখালেখি করতে শুরু করেন। কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। তখন থেকেই তিনি কুকি-চিন জাতীয়তাবাদী চিন্তার একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন বলে জানান হিল আর্টিস্টস গ্রুপের আরেক সদস্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিল্পী বলেন, কুকি-চিন নামে একটা জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরির উদ্যোগ আরও থেকেই ছিল নাথানের। এ নিয়ে লেখালেখিও করছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে ২০০৮ সালে কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও) নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের পক্ষে নাথান ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তার আর ভোট করা হয়নি। এর আগে নাথান ২০১৫ সালের দিকে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে আসেন।নাথানের গড়ে তোলা কেএনডিও নাম বদলে হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি)। আরও পরে ২০১৯ সালের দিকে হয়েছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এর সশস্ত্র উইংয়ের নাম দেওয়া হয় কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। কেথাকারএনএফের নামে খোলা ফেইসবুক পাতায়ও তাদের একটি সশস্ত্র শাখা  কথা স্বীকার করা হয়েছে।