আশঙ্কা ছিলই। আজ, শুক্রবার অবশেষে সেটিই সত্যি হল। লোকসভার সদস্যপদ খোয়ালেন রাহুল গান্ধী। তিনি এখন লোকসভায় ঢোকার যোগ্য নন। শুধু তাই নয় আগামী ছয় বছরের জন্য রাহুলগান্ধী কোন জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাও করতে পারবেননা। আজ, শুক্রবার সেই বিষয়ে লোকসভার সিদ্ধান্তটি সচিবালয়ের তরফে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, সাংসদ পদে আর থাকতে পারবেন না রাহুল গান্ধী। ভারতীয় সংবিধানের ১০২(১)-ই অনুচ্ছেদ এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আইন (১৯৫১)-র ৮ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সাংসদ পদ খারিজ হয়েছে বলে লোকসভার সচিবালয়ের তরফে জানানো হয়েছে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় কর্ণাটকের কোলারে আয়োজিত জনসভায় রাহুল গান্ধী ‘নরেন্দ্র মোদি, নিরব মোদি এবং ললিত মোদিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন ‘সব চোরের পদবিই কেন মোদি হয়?’ তার সেই মন্তব্যের পরই গুজরাতের সুরাট আদালতে মামলা দায়ের করেন বিধায়ক তথা সেই রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পূর্ণেন্দু মোদি। সুরাতের আদালত সেই ফৌজদারী মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে ২ বছরের কারাদণ্ড ও নগদ ১৫০০০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দিয়েছে।শাস্তি ঘোষণার পরই সুরাত আদালতেই গতকাল, বৃহস্পতিবার জামিনের আবেদন করেছিলেন রাহুল। তাতে সাড়া দিয়ে রাহুলকে ১০ হাজার টাকার বন্ডে ৩০ দিনের জন্য মুক্তি দিলেও বিচারক এইচ এস ভার্মা ২ বছরের শাস্তির কথা শুনান েবং দোষী সাব্যস্ত করার উপর কোন স্থগিতাদেশও দেননি।তবে সুরাত আদালত জামিন না দিলে রাহুল গান্ধী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যেতে পারতেন।
যার ফলে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হয়েছে। আর এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলার সাজা পেলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।’ তিনি বলেছেন মোদি পদবি মন্তব্যে সুরাত আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যাওয়ায় বড়সড় ধাক্কা খেল কংগ্রেস শিবির।
মানহানির মামলায় আদালত দোষী সাব্যস্ত করার পরে, বিজেপির সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী দর্শনা জারদোশ বলেছেন যে রাহুল গান্ধীর বক্তব্যে কেবল সুরাতেই নয়, গুজরাটের পুরো ওবিসি সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে এবং তিনি আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান।
এর আগে, রাহুল গান্ধীর আইনজীবী কিরিট পানওয়ালা বলেছিলেন যে গত সপ্তাহে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচএইচ ভার্মার আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি শুনেছেন এবং রায় ঘোষণার জন্য ২৩ মার্চের তারিখ নির্ধারণ করেছেন। রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির ৪৯৯ এবং ৫০০ (মানহানি) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে, রাহুল গান্ধী তার বক্তব্য রেকর্ড করতে সুরাত আদালতে হাজির হয়েছিলেন।
এ ব্যাপারে আইন বিশেষঙদের ববক্তব্য হলো, ভারীয় জনপ্রতিনিধিআইন অনুযায়ী কোন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে সেই সাংসদ বা বিধায়কের ২ বছর বা তার বেশী কারাদন্ডের আদেশ হলে তৎক্ষণাত তার সাংসদ বা বিধায়কের পদ চলে যাবে। রাহুলের সাংসদ পদ খারজ হওয়া্রই কথা ছিল। এটাই নিয়ম। এটাই সাংবিধানিক বিধান। তাই তাদের অভিমত রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ সংবিধান মেনেই করা হয়েছে।
এর আগে একটি মামলার রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আইনবিদরা জানান, ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট তৎকালিন কেন্দ্রীয় সরকার বনাম লিলি টমাস মামলায় আইনের সেই ধারাটি নাকচ করে দেয়। কারণ আদালত বলছে ২ বছরের কারাদন্ডের সাজার রায়ে ২ বছর সাজার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই সাংসদ পদ চলে যাবে। এর আগে বিধান ছিল সাংসদ বা বিধায়ক কেউ ২ বছরের বেশি সাজা হলেও তারা আরও তিনমাস সময় পাবেন স্থগিতাদেস পাওয়ার জন্য। কিন্তু পরে সেটা বাতিল হয়ে যায়। আইনবিদরা বলছেন, কংগ্রেস নেতা রাহুল নিজের খোড়া গর্তে নিজেই পড়েছেন। কারণ, বশস আগে পশুখাদ্য কেলেঙ্কারী নিয়ে মামলায় মনমোহন সিংহের সরকা অভিযুক্ত বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবের সাংসদপদ বাঁচাতে উঠে পরে লেগেছিল, সেই সময় মনমোহন সরকার সুপ্রিম কোর্টের ওই অধ্যাদেশ তথা রায় যেটা জারী হয়েছিল যে দু’বছরের বেশী সাজা হলেই সাংসদ বা বিধায়ক পদ চলে যাবে। কিন্তু মনমোহন সিং সরাকার সুপ্রিম কোটেরর সেই রায় বাতিল করে উল্টো পুরানো ব্যবস্থাই চালু করার কথা বলেছিল যে এই রকম রায় হলে তিন মাসের সময় দেয়া যাবে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায় বাতিল করার জন্য মনমোহন সরকার যে অধ্যাদেশ বা রায় বিঙপ্তি আকারে তৈরি করেছিল সেই অধ্যাদেশের কপি ছিড়ে ফেলে ছিলেন এই কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি। যার ফলে পিছু হটে ছিল তৎকালিন ইউপি সরাকার।
এবার সুপ্রিম কোর্টৈর সেই ২০১৩ সালের সেই নির্দেস অনুয়ায়ীই রাহুল গান্ধীর সাংসদপদ খারিজ হয়ে গেল।
এই ঘটনার পর নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষমতক্ষর অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে অন্যান্য বিরোধি দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলনের পথে নেমেছে কংগ্রেস। শুক্রবার তারা লোকসভা থেকে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদে অযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং বলেছে যে এটি করার ক্ষমতা কেবল রাষ্ট্রপতিরই রয়েছে।
কংগ্রেস সাংসদ মনীশ তেওয়ারি বলেছেন যে ভারতের সংবিধানের অধীনে কেবল রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে একজন এমপিকে অযোগ্য ঘোষণা করার। তিনি, সুরাট আদালতের ওই রায়কে ‘ভুল’ বলে অভিহিত করেন।
আম আদমি পার্টি (এএপি) সহ বিরোধী দলগুলি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর খারিজ প্রশ্নে সমাবেশ করেছে, বলেছে যে ভিন্নমতকে দমিয়ে রাখা উচিত নয় কারণ এটি গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ব্যহত করবে। তামিলনাড়ুর কুম্বাকোনাম এবং বিরুধাচালামে কংগ্রেস কর্মীরা রেল অবরোধ বিক্ষোভ করেছে। মানহানির মামলায় তাদের নেতার শাস্তির নিন্দা জানিয়ে তারা রাজ্য বিধানসভার সামনে বিক্ষোভ করেছে। মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, বিহার, কেরালা, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড় থেকেও কংগ্রেস দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে।
এদিন রাহুল সুরাট থেকে দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং তার আগমনে দিল্লির ঘরোয়া বিমানবন্দরে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাদ্রা সহ কংগ্রেসের অনেক নেতা এই বিষয়ে বিক্ষুব বক্তব্য রাখেন। হিন্দিতে একটি টুইটে, কংগ্রেস সভাপতি অভিযোগ করেছেন যে “কাপুরুষ, স্বৈরাচারী বিজেপি সরকার রাহুল গান্ধী এবং বিরোধীদের উপর ক্ষুব্ধ কারণ আমরা তাদের অপকর্ম প্রকাশ করছি এবং জেপিসি দাবি করছি।” “তার রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের অধীনে, মোদি সরকার পুলিশ, ইডি পাঠায় এবং রাজনৈতিক বক্তৃতার উপর মামলা চাপিয়ে দেয়। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব,” আপ আহ্বায়ক এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল অভিযোগ করেছেন যে অ-বিজেপি নেতা ও দলগুলিকে বিচারের মাধ্যমে “নির্মূল” করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন ও ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেনও রাহুল গান্ধীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বলেছেন, রাহুলকে দেওয়া সাজা গণতন্ত্রের জন্য উদ্বেগের বিষয়। স্টালিন এবং সোরেন উভয়েই কংগ্রেসের সাথে মিত্র হিসাবে জোট সরকার চালাচ্ছেন।