ঢাকা থেকে হরলাল রায় সাগর
পাকিস্তানের বর্বর-সাম্প্রদায়িক সরকার দ্বরা সংঘটিত একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে নর্মম ও বর্বোরিচিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করেছে দেশটির সরকার ও জনগণ। ক্রমশই এই যৌক্তক দাবী জোরালো হচ্ছে।
দুই বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বর্বর-সাম্প্রদায়িক সরকারের কব্জা থেকে মুক্ত হয় বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর টানা নয় মাস ভয়াল নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়। ইতিহাসের এই কলঙ্কিত দিনটিতে বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস পালন করে আসছে।
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে এই দিনটিকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু একাত্তরে চালানো বিশ্বের বর্বোরতম এই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি এখনও। দীর্ঘদিন ধরে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী নির্মম ওই হত্যাযজ্ঞকে ‘গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে। এই স্বীকৃতি আদায় সমস্ত বাঙালির কাছেই এখন আত্মমর্যাদার দাবি।গত ২৫ মার্চ গণহত্যা দবিস উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও গণহত্যা দিবসের আস্তর্জ্যাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়েছেন।১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি গণহত্যার আস্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। দিবাগত মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন ‘সার্চ লাইট’ নামে ভ্য়ঙ্কর বিভীষিকা শুরু করে। তাদের পূর্ব পরিকল্পিত নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হায়েনার দল। হায়েনাদের সঙ্গে ছিলো তাদের দোসর এদেশীয় রাজাকার, আলবদর ও আলশামস। বাড়ি-ঘর-অর্থ-সম্পদ লুটপাট, বাংক ডাকাতি, অগ্নিসংযোগ, অবকাঠামোর ক্ষতি, মানুষের ওপর নির্যাতন ও নারীদের ধর্ষণ-নির্যাতন করে বর্বর হানাদার বাহিনী ও তাদরে দোসররা। প্রায় ৩০ লাখ শহীদ এবং আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী ঘটানো হয়। ৯ মাসের যুদ্ধে এত বেশি মানুষ হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ভারত সরকারের সদয় সহযোগিতায় নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যা ২০২৩-এ ৫২ বছর পূর্ণ হলো। এ দিনটি জাতি উদযাপন করছে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অপারেশন সার্চলাইট নামের বাংলাদেশ আক্রমণের নির্দেশনামা তৈরি করে পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সেই আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইট কিভাবে পরিকল্পিত হয় তার স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি। পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।’
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরও তিন হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। তার পরে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’ পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
পাকিস্তান সরকারের চালানো এই জঘন্য ও ঘৃণ্য হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত এখনও শুঁকায়নি। হয়নি সেই নরপশুদের বিচারও। এমনকি স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও মিলেনি সেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তবে আশার কথা বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭১’র গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি উঠেছে।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করে, সেই সময় দেশটির একাত্তরের হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অতিসত্বর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলে, ভুক্তভোগীদের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো এবং অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনার পথ সুগম হবে। এই বিচারপ্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তা ও সমর্থন দিতে এবং সত্যের অন্বেষণ ও বিচারের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে থেকে পাকিস্তানকে চাপ প্রয়োগেরও আহ্বান জানায় লেমকিন ইনস্টিটিউট।এছাড়া গত বছরের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুইজন আইনপ্রণেতা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে একটি আইন প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কংগ্রেসম্যান রো খান্নার ১৯৭১ সালে বাঙালি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস কর্মকাণ্ডকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা হিসাবে ঘোষণা করার জন্য এ আইন পেশ করেন।
মিয়ানমারে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালের ২১ মার্চ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ওয়াশিংটন ডিসিতে হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘হলোকাস্ট (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর গণহত্যা) ছাড়াও বিশ্বে সাতটি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আজ অষ্টম গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কারণ, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।’ অথচ বাংলাদেশে চালানো পাকিস্তানের ভয়াবহ গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে থেকে পাকিস্তানকে সার্বিক সহযোগিতা করেছিল। এখন দেশ দু’টির সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যক সম্পর্ক অনেক ভালো। তারা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারে।
এদিকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানেরা। বিশ্বখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বির কন্যা ড. নুসরাত রাব্বি বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’ শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনির বলেন, সবার আগে পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। ৯ মাসের সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে টাকার অঙ্কে এই ক্ষতিপূরণ হিসেব করা যাবে না। ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য বাংলাদেশ সরকার এককালীন অনুদান চাইতে পারে, যা দুঃস্থ যুদ্ধাহত, শহীদ ও বীরাঙ্গনা পরিবারদের পুনর্বাসন ও কল্যাণে ব্যয় করা হবে।শহীদ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের পুত্র গণহত্যা গবেষক তৌহিদ রেজানুর বলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে একাত্তর জুড়ে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী ও তার দোসররা বাংলাদেশের ওপর যে জেনোসাইড পরিচালনা করেছিলো সেজন্য পাকিস্তানের কাছে প্রথম দাবি হবে তারা যেন স্বীকার করে যে বাংলাদেশের ওপর তারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। তাদের এ কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানকে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। এটি লোক দেখানো ভণিতা যেন না হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।