ঢাকা থেকে হরলাল রায় সাগর
বাংলাদেশকে ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসির বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। আজ বৃহস্পতিবার দুই দিনের বাংলাদেশ সফর শেষ করেছেন তিনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি ভারতের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি, বাংলাদেশকে ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসি’র একটি অপরিহার্য অঙ্গ ও ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’র মূল অংশীদার হিসেবে তুলে ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা পৌঁছে দেন।
পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে শুভেচ্ছা জানান। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম তোফাজ্জেল হোসেন মিয়ার সঙ্গেও বৈঠক করেন তিনি। ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের সফরের আনুষ্ঠানিকতা বুধবারই শেষ হয়েছে। তিনি আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা ছাড়েন। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের আমন্ত্রণে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার এবং সহযোগিতার গতি বাড়াতে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা।
ভারতের সঙ্গে এ বছর বাংলাদেশের ১৫ থেকে ২০টি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সিরিজ বৈঠকের শুরুতে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রার বাংলাদেশে সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করবে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান সহযোগিতার গতি বাড়াবে। এই সফর ভারতের ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ (প্রতিবেশীই প্রথম) নীতি অনুসারে ‘সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের’ সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ ভারতের শীর্ষ সবচেয়ে উন্নয়ন অংশীদার এবং এই অঞ্চলে তার বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) চলাকালে পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এই সম্পর্কের সব দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। উভয় পক্ষই ভারত সরকারের অর্থায়নে রেয়াতি লাইন অব ক্রেডিট, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা এবং মানুষে-মানুষে বন্ধনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছেন। তারা যৌথ স্বার্থের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সহযোগিতা ও পরামর্শ বাড়াতে সম্মত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জি-২০’র প্রেসিডেন্সি চলাকালীন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে ভারত ভীষণভাবে উন্মুখ। উভয় পক্ষই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদের জন্য আসন্ন প্রার্থিতার ব্যাপারে পারস্পরিক সমর্থন প্রদান করতে সম্মত হয়েছে বলে জানায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে গত দশকে ভারত ও বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় পর্যায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চ সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছে। পররাষ্ট্র সচিবের সফর দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করতে সাহায্য করেছে। সময়ের সঙ্গে পরীক্ষিত তাদের এই সম্পর্ককে পুনরায় বলবত করেছে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি ব্যাপকভাবে পর্যালোচনার সুযোগ দিয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিস্তৃত পরিসর নিয়ে আলোচনার ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) যোগ দিতে গত মঙ্গলবার দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। নেপাল সফর শেষ করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা পৌঁছালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে এটাই বিনয় কোয়াত্রার প্রথম ঢাকা সফর। ২০২২ সালের ১ মে নতুন পদে দায়িত্ব নেওয়ার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সফরসঙ্গী হিসাবে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারতের পূর্ণ সমর্থন: সফরের দ্বিতীয় দিনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাস ভবন ‘গণভবন-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকাৎ করেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এম তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন আছে। বিনয় কোয়াত্রা বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ উন্নয়নযাত্রায় ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে। বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব শেখ হাসিনাকে চলতি বছরের ৯ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠেয় ‘গ্রুপ অব টোয়েন্টি (জি২০)’ শীর্ষ সম্মেলনের ১৮তম আসরে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান। গত ১ ডিসেম্বর থেকে আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জি২০-এর সভাপতির দায়িত্বে থাকা ভারত গ্রুপটির সব বৈঠকে বাংলাদেশকে ‘অতিথি দেশ’ হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ় বলে বর্ণনা করে বিনয় কোয়াত্রা বলেন, সারা বিশ্ব এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মূল্যায়ন করে। এই সম্পর্ক এরই মধ্যে কৌশলগত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সম্পর্ক আরও মজবুত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী ভারতকে ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এই বন্ধুত্ব আরও গভীর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দুই প্রতিবেশীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উভয় দেশই কাজ করতে পারে।
সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশ যাতে সহজেই ঋণ নিতে এবং তা পরিশোধ করতে পারে, সে জন্য তাঁরা ভারতীয় ঋণের শর্ত সহজ করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য দুই দেশের স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার করেই পরিচালনা করা যেতে পারে।
তিস্তা চুক্তির জন্য ভারতকে আহবান : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ছাড়াও বুধবার দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন বিনয় কোয়াত্রা। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এদিন সন্ধ্যায় ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে তিস্তা চুক্তিসহ অনিষ্পন্ন বিষয় নিষ্পত্তির জন্য ভারতের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘তিস্তা ইস্যু নিয়ে অনেক আগে থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। আমরা তিস্তার পানিবণ্টন ও কুশিয়ারা চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে ভারতের প্রতি আহবান জানিয়েছি।’
আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে আলোচনা হয়নি : এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, আদানির বিদ্যুৎ নিয়ে আলাদা করে আলাপ হয়নি। এটি সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। তবে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নিয়ে আলাপ হয়েছে। তারা নেপাল-ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনতে সহযোগিতা করবে। তবে এ জন্য বাংলাদেশ অংশে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা হবে। প্রয়োজনে ভারতের ঋণে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বাড়াতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া ‘সেপা’ চুক্তি দ্রুত করতে আলোচনা হয়েছে। সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি-বিএসএফের ভূমিকা বাড়ানো নিয়েও আলাপ হয়েছে। তাহলে সীমান্ত হত্যাও কমে আসবে।
সহযোগিতা বাড়াতে সম্মতি : ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব কোয়াত্রা দুই দেশের সম্পর্কের সব দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। উভয় পক্ষই ভারত সরকারের অর্থায়নে রেয়াতি ঋণ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা, মানুষে মানুষে বন্ধনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চলমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে।
ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, উভয়ে যৌথ স্বার্থের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সহযোগিতা ও পরামর্শ বাড়াতে সম্মত হয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের জি২০-এর প্রেসিডেন্সি চলার সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে ভারত ভীষণভাবে উন্মুখ। উভয় পক্ষই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদের জন্য আসন্ন প্রার্থিতার ব্যাপারে পারস্পরিক সমর্থন জানাতে সম্মত হয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে গত দশকে, ভারত ও বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় পর্যায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চ সম্পৃক্ততা বজায় রেখেছে। পররাষ্ট্রসচিবের সফর দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী অংশীদারি আরো জোরদার করতে সাহায্য করেছে, সময়ের সঙ্গে পরীক্ষিত তাদের এই সম্পর্ক পুনরায় বলবৎ করেছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করার সুযোগ দিয়েছে।