বাংলাদেশ প্রতিনিধি

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিতর্কে জড়িয়ে পরলো কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশন অফিস। ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্যে একটি ভুঁইফোড় বেসরকারী সংস্থাকে  মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে।

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ভিসা প্রসেসিংয়ের এই কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা। তবে তার আগেই বিতর্কের মুখে পড়লো প্রক্রিয়াটি।

কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশন বাংলাদেশের ভিসা প্রসেসিংএর জন্যে একটি বেসরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে এবং সেই সংস্থাকে কাজ পাইয়ে দিয়ে বিরাট অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সেখানে নিযুক্ত ডেপুটি  হাই কমিশনার তৌফিক হাসানের বিরুদ্ধে। সংস্থাটিকে বাছাই করার আগে কোন টেন্ডার জারিও করা হয়নি।

মাত্র ৮ মাসের যে সংস্থাটিকে কলকাতার ডেপুটি হাই কমিশন ভিসা প্রসেসিং এর দায়িত্ব দিতে চলেছে তাদেরচেয়েও ভারতে অনেক পুরাণো ও বড় প্রোফাইলের  সংস্থা  রয়েছে, কিন্তু টেন্ডার আহবান না করে গোপনে ওই সংস্থাটিকে কাজের বরাত দেয়ায় আনেক নামি দামি সংস্থাক বঞ্চিত করা হয়েছে। এমন অনেক সংস্থার পক্ষথেকে এই অভিযোগ করা হয়েছে।

বিশেষ কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বিনা টেন্ডারে এই সংস্থাকে কাজ দেয়ার চুক্তিপত্রেও  ত্রুটি রয়েছে। ওই চুক্তিনামায় নিয়ম অনুযায়ী উপ-হাইকমিশনারের সাথে যৌথ সই করার কথা হেড অফ চেঞ্চুরী (এইচওসি)-র, কিন্তু চুক্তিপত্রে উপ-হাইকমিশনারের সাথে যার সই রয়েছে তিনি প্রথম সচিব (রাজনৈতিক-৩) যিনি চুক্তিপত্র সম্পন্ন হওয়ার দুমাস আগে উপ-হাইকমিশনে যোগদান করেছেন। কাজের বরাতের পর এমন প্রশ্নও জোরেশোরে উঠেছে যে, এক লক্ষ টাকা যে কোম্পানির  পরিশোধিত মূলধন, কোন হিসেবে তাদেরকে  প্রায় ৯০ কোটি টাকার কাজ দেয়া হলো?

প্রসঙ্গত, করোনাকালের আগে কয়েক বছরে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন অফিস বছরে এক লক্ষ কুড়ি হাজার ভিসা প্রদান করেছে। প্রতি ভিসার জন্য নতুন এই সংস্থাটি ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা প্রসেসিং ফি আদায় করবে যার পরিমাণ প্রায় ৯০ কোটি টাকা বছরে। কিন্তু ওই ফি আদায়ের টাকার একটি কানা কড়িও বাংলাদেশের রাজস্বখাতে জমা হবেনা। ভিসা প্রসেসিংয়ের ওই অর্থ সব্ই ওই সংস্থার নিজস্ব আয় হিসেবেই গণ্য হবে বলে জানা যায়।

সূত্র জানায়, উপ-হাইকমিশন ৫০ বছর ধরে অত্যান্ত সু-শৃঙ্খলভাবে ভারতীয় নাগরিকদের বিনাখরচে হাজার হাজার ভ্রমণ ভিসা প্রদান করে আসছে,  কিন্তু হঠাৎ করে শুধুমাত্র কলকাতা উপ-হাইকমিশনেই ভিসার মত একটি গুরূত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়টি প্রসেসিংয়ের দায়িত্ব বাইরের একটি বেসরকারী সংস্থার হাতে ছেড়ে দেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিষয়টির ক্ষেত্রেও গুরুতরভাবে ব্যহত হওয়ার অশঙ্কা করছেন অনেকেই।

আর এই কারণেই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে নতুন সংস্থাটিকে দিয়ে ভিসা প্রসেসিং কাজ শুরু করাতে উঠে পড়ে লেগেছেন উপ-হাইকমিশনার। এর পেছনের কারণ কি তাহলে এটিই যে আগামী বছরের জানুয়ারিতে  উপ-হাইকমিশনারের বদলি এবং তার আগেই অবৈধ আয়ের অর্থ গুটিয়ে ফেলতে চান তিনি?- এমন সন্দেহও করছেন অনেকেই।

এদিকে, চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই কোম্পানিটি ভিসা জমা নেয়ার জন্য কলকাতার অদূরে  সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে একটি অফিস ভাড়া নিয়েছে। যেখানে ভিসার আবেদন জমা দিতে ও ভিসা নিতে যেতে সাধারণ মানুষকে চূড়ান্তভাবে নাকাল হতে হবে। কারণ কলকাতার অদূরের ওই এলাকায় গণপরিবহন ব্যাবস্থা একান্তই অপ্রতুল।

এই পদক্ষেপের ব্যাপারে কলকাতার কূটনৈতিক মিশন থেকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে আরও জোরালো করার কথাই বলা হয়েছে। ‌উপ-হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, ‘এই পদক্ষেপ কূটনৈতিক মিশনে আরও নিরাপত্তা বাড়াবে। প্রতিদিন শত শত লোক অফিসে ভিড় করে, একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য জন-সাধারণের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। তাছাড়া, অন্যান্য কনসুলেটগুলির বেশিরভাগই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাদের আশেপাশে ভিড়ের অনুমতি দেয় না।’

প্রসঙ্গত, কলকাতা  মিশন অফিস ১৯৭১ সাল থেকে দেশের প্রথম বিদেশি মিশন এবং সেখানে ৫০ বছর ধরে ভিসা প্রদান করে আসছে। এর আগে ভারতের অন্য কোনও কূটনৈতিক অফিস থেকে বাংলাদেশের ভিসা করাতে ভারতীয়দের অর্থ না লাগলেও, কলকাতা থেকে ভিসা করাতে প্রত্যেক ভারতীয়কে এই ব্যবস্থার পর থেকে ৮০০ থেকে ৮৫০ রুপী করে ভিসা প্রসেসিং ফি বাবদ দিতে হবে । বাড়তি অর্থ গুণে তারা পাবে দূরবর্তী স্থানে যাতায়াতেরও হেনস্থা।

উল্লেখ্য, এই ভিসা প্রসেসিং প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার অনেক আগে এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে, এমনকি এই ভিসা প্রসেসিংয়ের ব্যাপারে জনগণের অভিমত জানিয়ে বাংলাদেশ ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সংবাদে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখহাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশেরে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণের অভূতপুর্ব অবদানের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে ভারতের নাগরিকদের কোন অর্থ ব্যয় করতে হবেনা, অর্থাৎ বিনা খরচে তারা ভিসা পাবেন। তার পরেও ভারতের কোন মিশনে-ই নয় শুধুমাত্র কলকাতায় ভিসা প্রসেসিং ফি কেন নেয়া হবে? এর উত্তরে যুক্তি দেখানো হয়, ভিসা ফি তো নেয়া হ্চ্ছেনা শুধুমাত্র প্রসেসিং ফি নেয়া হবে। কিন্তু শুধু কলকাতা মিশনে কেন এই ব্যাবস্থা করা হবে?

এ প্রসঙ্গে কলকাতার প্রবীণ সাংবাদিক স্বপন বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের নিবিড় সম্পর্ক।  তাদের বহু আত্মীয়-পরিজন ভারতে থাকেন, আবার বাংলাদেশেও। এরা বেশীর ভাগই  সাধারণ মানুষ, য়ারা আগে বিনা ব্যায়ে ভিসা পেত তাদের পক্ষে ওই মোটা  টাকার ভিসা প্রসেসিং ফি দিয়ে বাংলাদেশের পরিজনদেরর সাথে দেখা করতে  য়াওয়া মোটেই সম্ভব হবেনা। তিনি বলেন, কলকাতা ভিসা উইং থেকে বিগত ৫০ বছর ধরে অত্যান্ত নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে সহজেই ভারতীয় নাগরিকদের ভিসা দেয়া হতো, হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্তের ফলে  সিস্টেমের জটিলতা বাড়াবে।

Final Agreement for Visa Outsourcing at BDHC Kolkata, 7 Oct 2021 (2)

এ  ব্যাপারে এই প্রতিনিধি বিস্তারিত জনতে কথা বলার জন্য কলকাতা উপ-হাইকমিশনার তৌফিক হাসানের সাথে কয়েকবার যোগা যোগ করা হলেও ফোনে তাকে পাওয়া যানি।