কিশোর সরকার, বাংলাদেশ থেকে

ঢাকা, ২২ জানুয়ারি : বর্তমানে বাংলাদেশের  বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার। এই হিসাবেই বাংলাদেশে আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮৫ দশমিক ২১ টাকা হিসাবে বাংলাদেশি টাকায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা ৬৯ পয়সা। কিন্তু উন্নয়নের নামে অপ্রয়োজনীয় খাতে ঋণ সহায়তা, অসাধু আমলাদের সহায়তায় নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে ঋণ দেওয়া, এবং এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাঙ্ক (এডিবি) ও ইসলামি উন্নয় ব্যাঙ্ক-সহ বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পের আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কম দর দেখিয়ে কাজ হাতিয়ে নেয়া, পরবর্তিতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই কাজের বরাত বৃদ্ধি ও  অর্থের পরিমান বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশে কাজ করতে আসা  চিনা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। আর উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে নিজেকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আস্থাভাজন তৈরি করতে নানা প্রচারণা চালাচ্ছে  চিন। এই সুযোগে চিনে উৎপাদিত নিম্নমানের নিষিদ্ধ জিনিসপত্র রফতানি করছে বাংলাদেশে। যার ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের উপরে। শ্রীলঙ্কার মতোই বাংলাদেশকেও দেউলিয়া করার চক্রান্ত করছে চিন, এমনই অভিমত বাংলাদেশের বিশিষ্ট জনের।  ভিওসি-র বাংলাদেশ প্রতিনিধি কিশোর সরকারের সঙ্গে আলাপচারিতায় এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের ইসলামী চিন্তবিদ, প্রাক্তন বাণিজ্য মন্ত্রী,  প্রাক্তন গভর্ণর ও অর্থনীতিবিদ।

চিন মানবতার শত্রু , মিছবাহুর রহমান : বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান ইসলামী চিন্তাবিদ মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, সরকারের আমলাদের পরামর্শে চিনকে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। দেশের কিছু অসাধু আমলাদের দ্বারা উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকগুণ অর্থ।  চিনা ঋণের এসব প্রকল্পে আকাশ ছোঁয়া ব্যায় ধরা হয়েছে। ভারতের ঋণে যেখানে এক কিলোমিটার রেল লাইন নির্মাণে ১০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে সেখানে চিনের ঋণে নির্মাণাধীন প্রকল্পে একই রেলপথ নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১৩২ কোটি টাকা। ১৮ হাজার কোটি টাকার পদ্মা রেল যোগাযোগ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৪১ হাজার কোটি টাকা করে নিয়েছে চিন। এটা শুধু একটি প্রকল্পে নয় চিনের টাকায় বা অন্যান্য দাতা সংস্থার ঋণের টাকার কাজের ক্ষেত্রেও চিনা কোম্পানি একই রকম করছে। এর সঙ্গে দেশীয় কয়েকটি কোম্পানি ও কিছু অসাধু আমলা জড়িত রয়েছে। এরাই কানাডার বেগম পাড়া-সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে টাকা পাচার করে বাড়ি করছে। তিনি আরও বলেছেন, এমনকি ইসলামিক রীতি অনুযায়ী যে-সব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ফানুস এবং আতশবাজি বিক্রি করছে বাংলাদেশে। চিনা এসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে মিথ্যা এইচ এস কোড ব্যবহার করে। এ বছর ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে চিন থেকে আমদানি করা নিম্ন মানের নিষিদ্ধ ফানুসে রাজধানী ঢাকার অন্তত ১১টি স্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আতশবাজির শব্দে শিশু-সহ বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন মৃত্যু হয়েছে। চিনের কারখানায় প্লাস্টিকের চাল ও কেমিক্যাল দিয়ে ডিম তৈরির দৃশ্য দেখেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাই চিন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী হলেও এরা কারও বন্ধু হতে পারে না। এরা  মানবতার শত্রু।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেছেন, ঋণ দেওয়ার কথা শুনলেই আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত নয়। যে আমলাদের পরামর্শে বুলেট ট্রেন করার সমীক্ষা বাবদ ১১০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে তাদের বিচার হওয়া দরকার। নিজেদের স্বার্থে আমলারা এটা করিয়েছেন। আমলারা জানেন নারায়ণগঞ্জ থেকে লাকসাম ও কুমিল্লা কডলাইন হলে চট্টগ্রামের সঙ্গে ৯০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে। এতে সময় ও ভাড়া দুই কমবে। কিন্তু জনবান্ধব কাজে আমলাদের আগ্রহ কম। কারণ   তাদের পকেট ভারী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায়।

বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতির বর্তমানে যে অবস্থা তাতে এখনই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হওয়ার মতো অবস্থায় যায়নি। তবে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এখনই সজাগ হওয়া দরকার। আর দেশী ও আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশগ্রহণ করে  সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজ নিয়ে পরবর্তিতে নানা অজুহাত দেখিয়ে সময় ও কাজের পরিধি বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যায় তিন/চারগুন করা যাতে সম্ভব না হয় সে ব্যাপারে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনকেখতিয়ে দেখতে হবে, কমিশনকে সে ক্ষেত্রে  নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়াতে হবে। নতুন করে প্রতিটি প্রকল্পে ব্যায় বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রাক্তন বাণিজ্য মন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটির বেশি প্রবাসী রয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স জিডিপিতে অবদান রেখেছে ১২ শতাংশের বেশি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের রিজার্ভ বাড়ছে। কিন্তু বিমান বন্দর-সহ দেশের অধিকাংশ জায়গায় প্রবাসীদের সঠিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ-সহায়তার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। তবে আমলাদের পরামর্শে উন্নয়নের নামে ঋণের টাকা লুটপাট বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশও শ্রীলঙ্কা হতে সময় লাগবে না। কারা অপ্রয়োজনীয় ঋণের জালে আটকে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া বানিয়েছে তাদের ব্যাপারেও শুধু সরকার নয় দেশবাসীকেও সজাগ থাকতে হবে।