ভাষা-মোদের ভালবাসা। সবাইকে নিয়ে বাঁচার আশা : মমতা বন্দোপাধ

প্রণব ভট্রাচার্য্য

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কি ভুলিতে পারি৷’ ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর ঢাকায় পুলিশের নির্মম গুলির ক্ষত আজও টাটকা। ইতিহাসের সে এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। উর্দু নয় বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ববঙ্গের এই লড়াই আজও শিহরণ জাগায়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উন্নীত করার জন্য প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটি ২০০০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে।

দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “বহুভাষিক শিক্ষার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ”। ইউনেস্কো বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রযুক্তির সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবে এবং সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষার উন্নয়নে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশের ঢাকার ঐতিহাসিক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ দেশব্যাপী সমস্ত শহীদ বেদীতে প্রভাতফেরী, পুষ্পমাল্য অর্পণসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শহিদ দিবস পালিত হয়েছে। উর্দু নয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতেই পূর্ববঙ্গের এই লড়াই আজও শিহরণ জাগায়। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও সাড়ম্বরে পালিত হয় এই দিবসটি। এদিন, দমদম সিঁথির মোড়ে প্রভাতফেরিতে সামিল হন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। অন্যদিকে, শান্তিনিকেতনে রঙিন আলপনায় সেজে উঠেছে বিভিন্ন রাস্তা। সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ ভবন। তৈরি করা হয়েছে শহিদ বেদি। শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লির ছাত্রাবাস থেকে পদযাত্রা শুরু হয়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে শিক্ষার্থীদের যাত্রায় পা মেলান বিশ্বভারতীর অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা।

উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসাতে প্রভাতফেরী ও ভা্যা শহীদের প্রতি পুষ্পমাল্য ও শ্রদ্ধাঞ্জলীর প্রদানের মধ্য দিয়ে দিবসতি পালিত হয়। সাকুরা একাডেমী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

ভাষা দিবসে উপ রাষ্ট্রপতি এম ভেঙ্কাইয়া নাইডুর বাণী

উপরাষ্ট্রপতি, শ্রী এম. ভেঙ্কাইয়া নাইডু েদিন বলেছেন, ‘ভাষা’ একটি মৌলিক বন্ধন যা মানুষকে একত্রিত করে এবং মাতৃভাষা রক্ষা ও সংরক্ষণের অভিযানের জন্য দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, “আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলি তবে আমরা তো আমাদের পরিচয় হারাবো”।

‌আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আর্থ সায়েন্স মন্ত্রক আয়োজিত একটি ইভেন্টে ভাষণ দিতে গিয়ে উপরোক্ত তাগিদের কথা বলেছেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট আমাদের সময়ের পরিবর্তিত চাহিদাগুলির সাথে ভাষাগুলিকে আরও জোরদার করা তথা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেগুলিকে উন্নীত করার জন্য সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী উপায়গুলি খুঁজে বের করার আহ্বান জানান৷

ভাষাদিবসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছা

মুখ্যমন্ত্রী ট্যুইটে , ‘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা জনিয়ে টুইটে লিখেছেন, ‘মাতৃভাষার জন্য যাঁরা বীরের মতো লড়াই করেছেন, সেইসমস্ত শহিদদের প্রতি আমি স্যালুট জানাই। ভারতে আজ ভাষার এই বহুত্ববাদকে পরিসরে উদ্‍যাপনের প্রয়োজন। আমরা সব ভাষাকে ভালবাসি, আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে ভালবাসি। ভাষা-মোদের ভালবাসা। সবাইকে নিয়ে বাঁচার আশা ‘

ভাষা ও চেতনা পাঠশালার বাংলাভাষা উৎসব

২০ ফেব্রুয়ারি রবিবার বিকাল ৫ টার সময় কলকাতা আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে রাণুচ্ছায়া মঞ্চে শুরু হয়  বাংলাভাষা উৎসব।  নবজাগরণ  এবং  ভাষা ও চেতনা সমিতির যৌথ আয়োজনে এই  উৎসব পালিত হয়।

উৎসবে নাচ-গান, কবিতা ও নাটক একসঙ্গে  খাওয়া এই উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ইছাপুর সন্ধিক্ষণ নাট্যদলের প্রযোজনা ‘সাইকেল’ এবং কলকাতার প্রতিকৃতি নাট্যদলের নাটক ‘বীরসা মুণ্ডার গান’ পরিবেশিত হয়। এছাড়াও পরিবেশিত হয় লোকনৃত্য, বাউল ফকির গান। আসাম ত্রিপুরা বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গের বহু শিল্পী যোগ দেয় এই অনুষ্ঠানে। আকাদেমির সামনে রাস্তা জুড়ে দেওয়া হবে একুশের আলপনা। ১৯৯৮ থেকেই এই আলপনা দেওয়ার কাজ করে আসছে ভাষা ও চেতনা সমিতি।  আসাম, ত্রিপুরা ,  বাংলাদেশ  ও পশ্চিমবঙ্গের  বহু শিল্পী উৎসবে  যোগ দেবেন। আকাদেমির সামনে রাস্তা জুড়ে দেওয়া  হয় একুশের আলপনা । ১৯৯৮ থেকেই এই আলপনা  দেওয়ার  কাজ   করে আসছে  ভাষা ও চেতনা সমিতি।

এই উৎসবের উদ্বোধন করেন কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপদূতাবাসের কাউন্সেলর কনস্যুলার মো: বশির উদ্দিন। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন প্রথম সচিব মোহাম্মদ শামছুল আরিফ, গায়ক প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কবি অরুণ চক্রবর্তী, শিল্পোদ্যোগী আলমগীর ফকির, নগরবাউল রঞ্জন প্রসাদ, নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়, অংশুমান ভৌমিক, নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়,  তীর্থ বিশ্বাস,

এ ছাড়া ২১ শে ফেব্রুয়ারী মানিকতলা খালপাড়ে ভাষা ও চেতনা পাঠশালার সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা প্রভাতফেরি করে শহরের  মানিকতলা ও নারকেলডাঙ্গা  খালপাড় শীতলা  মন্দিরসহ এলাকা  পরিক্রমা করে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।। তাদের সবার হাতে ছিল বর্ণপরিচয়, ছড়ার বই, ধারাপাত ও খাতা।  প্রভাতফেরি শেষে সবাইকে ফল বিতরণ করা হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বিশিষ্ট বাঙালিদের সম্মাননায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ

 ২১ শে ফেব্রুয়ারী সকাল ১০ টায় শুরু হয় অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পর্ব।  কলেজের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষের সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সম্মানীয় ডেপুটি হাই কমিশনার।

উপলক্ষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পার্কস্ট্রিট প্রাঙ্গণে আয়োজিত হয় ‘দশভুজা বাঙালি’, ২০২২ অনুষ্ঠিত হয়।  ২০১১ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে, মাতৃভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে এই অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। প্রত্যেকবারই এই অনুষ্ঠানে থাকে কোনও না কোনও অভিনবত্ব। এই অনুষ্ঠানে ১০জন বিশিষ্ট বাঙালিকে সম্মাননা দেওয়া হয়। বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুধীর সরকার, জয় গোস্বামী, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট বাঙালিরা।

সোমবার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ অডিটোরিয়ামে, ২০২২ সালের দশভুজা অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করা হয় অভিজিৎ চৌধুরী, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, কোয়েল মল্লিক, পি সি সরকার জুনিয়র, সম্রাট ঘোষ, প্রচেত গুপ্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শান্তনু মৈত্র, সুপ্রিয়া রায় এবং বাংলাদেশের মেজর অব: শামসুল আরেফিনকে। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে দেয়া হয়  লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। সকাল ১০ টায় শুরু হয় অনুষ্ঠানের প্রাথমিক পর্ব।  কলেজের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষের সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের  ডেপুটি হাই কমিশনার।

অনুষ্ঠানের মূল পর্বে উপস্থিত ছিলেন ‘দশভুজা’য় আমন্ত্রিত বিশিষ্ট বাঙালি ব্যক্তিত্বরা। সাধারণত, সংযোগ ও দশভুজা দু’টি পর্বে সংগঠিত হয় এদিনের অনুষ্ঠান। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে ও অংশগ্রহণে ভাষা দিবসের উদযাপনে মেতে ওঠে কলেজ প্রাঙ্গণ। লকডাউন পরবর্তী বিভীষিকায় শুধুমাত্র ‘দশভুজা বাঙালি’র আয়োজন সম্ভবপর হয়েছে বলে জানিয়েছেন সমিতির কার্যনির্বাহী সংস্থা।

সেরা তিনিই, যিনি সবার মাঝে থেকেও ছাপ রাখেন স্বকীয়তার। আলাদা তিনিই, যিনি পথ দেখান বাকি সকলকে। আর ‘দশভুজা বাঙালি’? হ্যাঁ, তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি বাংলার মুখ সারা বিশ্বকে দেখিয়েছেন। পথ প্রদর্শক হিসেবে যাদের উজ্জ্বল উদাহরণকে সামনে রেখে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বাকিরা। প্রতি বছরের মতো এবছরও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এরকমই ব্যতিক্রমী বাঙালিদের সম্মান প্রদর্শন করল। গত ২০১১–তে শুরু হওয়া দশভুজা বাঙালি নামে এই অনুষ্ঠানে এবছরই প্রথম এই সম্মান জানানো হল একজন বাংলাদেশীকে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর এএসএম সামসুল আরেফিন।
সন্মননা পেয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমি গর্বিত। ভাষা শহিদ দিবসে এই সম্মান পেয়ে একজন বাঙালি হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করছি।’ মনোজ্ঞ এই অনুষ্ঠানে এদিন সকলকেই সম্মানিত করেন কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার ডমিনিক স্যাভিয়ো এবং রেক্টর ফাদার জয়রাজ ভেলুস্বামী।