কিশোর সরকার, বিশেষ সংবাদদাতা

ঢাকা, ২৩ মে : পোশাকি নাম-‘চায়না দুয়ারি’ অথবা চায়না জাল, চিনে তৈরি মাছ ধরার এই জাল অচিরেই বিনাশ করছে ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীর মৎস্য সম্পদ। অত্যন্ত হালকা ও সূক্ষ্ম বুননের ছোট ফাঁসের এই জালে সহজেই আটকে পড়ে ছোট অথবা মাঝারি ধরনের মাছ, বেরোতে না পেরে বেঘোরে প্রাণ হারায় নানা প্রজাতির মাছ, রেণু পোনা। ‘চায়না দুয়ারি’ নামক এই জাল চোরাই পথে ঢুকে পড়ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, যা চলে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার মৎস্যজীবীদের কাছে।
কম পরিশ্রমে বেশি মাছ ধরতে পারায় এই জাল ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের মৎস্যজীবীদের কাছেও অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু, এই জাল বিনাশ করছে দুই দেশের মৎস্য সম্পদ। চিনের সর্বনাশা এই মাছ ধরার জাল বন্ধ করতে আহ্বান জানালেন বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক কিশোর সরকারের সঙ্গে মত বিনিময় করছেন সে দেশের রাজনীতিবিদ, মৎস্য সম্পদ আহরনের পেশার সঙ্গে যুক্ত মৎস্য সংগঠনের নেতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক।ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিসারম্যান এসোসিয়েশন এর সহ সম্পাদক সতিনাথ পাত্র বলেন, চায়না জাল বা চায়না দুয়ারের কথা শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্র উপকূল এলাকায় ঢুকে পড়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে চোরাইপথে এ-জাল আসা বন্ধে ভারত সরকারকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে অঙ্কুরে বিনাশ হবে দেশের প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত মৎস্য সম্পদ। কেনা এ-জালে রেনুপোনা থেকে শুরু করে ছোট আকারের সবধরণের মাছ আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। ‘উপকূলে নেট জালের মাধ্যমে বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা শিকার হতো। তখনো এ রকম সংকটে পড়েছিলাম আমরা। প্রকৃতিক উৎস থেকে রেনু সংগ্রহের চেয়ে হেচারিতে উৎপাদিত পোনা টেকে বেশি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না। তাই প্রাকৃতিক উপায়ে সংগ্রহ করা বাগদা চিংড়ির রেনু পোনা ঘের মালিকারা না কেনায় মশারির নেটের সাহায্যে বাগদা পোনা সংগ্রহ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু চায়না জাল দু-দেশের মানুষদের নতুন করে মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ফেডারেশনের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ বর্মন বলেছেন, বাংলাদেশের দক্ষিণে শুধু নয় ভয়ংকর ‘চায়না দুয়ারি জাল ভারতের জেলেদের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গোল লম্বাকৃতির এই জাল স্রোতের মুখে ফেলে রাখলে জোয়ার-ভাটার জলে ভেসে আসা ছোট–বড় মাছ একবার ভেতরে ঢুকলে আর বেরোতে পারে না। ফলে এই জালে অসংখ্য মাছ, মাছের পোনা-সহ সব ধরনের জলজ প্রাণী-উদ্ভিদ, খাদ্যকণা (প্লাঙ্কটন) ধ্বংস হচ্ছে। এতে মাছের বংশবিস্তার মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চায়না দুয়ারি জালকে ‘ফাঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এটা কারেন্ট জালের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এই জালে মাছ একবার ঢুকলে আর বের হতে পারে না। জালটি বাংলাদেশে ‘চায়না জাল’, ‘ম্যাজিক জাল’ নামেও পরিচিত। তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে মাছ ধরার জালের ফাঁসের অনুমোদিত পরিমাপ রয়েছে, সাড়ে ৫ সেন্টিমিটার (সংশোধিত আইন)। জালের ‘ফাঁস’–এর চেয়ে কম হলে তা আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। দেশে নিষিদ্ধ জালের তালিকায় চায়না দুয়ারির নাম উল্লেখ না থাকলেও বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এটি নিষিদ্ধ। আগে সরাসরি চিন থেকে আসতো। তবে এখন সুতা চায়না থেকে আসে, জালটি এখন বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। আর জালের সুতো চিন থেকে আসায় জালটির নামের সঙ্গে ‘চায়না’ শব্দটি যুক্ত হয়ে গেছে। বিশেষ এই জালের দুই মাথা খোলা বলে একে ‘দুয়ারি’ বলা হয়।

বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের উপজেলা শ্যামনগরের বিশিষ্ট সাংবাদিক গবেষক আকবর কবির বলেন, এই চায়না জাল চোরাই পথে ভারতেও ঢুকে পড়ছে। তাই প্রাকৃতিক উৎসের ছোট ও মাঝারি মৎস্য সম্পদ রক্ষায় এই জালের সুতো আমদানি, জাল উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় বন্ধে উভয় দেশকেই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত বেশি তাই দুই দেশকে সকল বিষয়ে মিলেমিশে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই।

চিনকে বিশ্ব মানবতার শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেহে জেবুন্নেসা রহমান টুম্পা। তিনি বলেন, মানবতার চেয়ে চিনের কাছে অর্থটাই বড়। স্বাধীনতার সময় থেকে দেশটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশকে দেউলিয়া বানানোর এটাও একটা ষড়য্ন্ত্র হতে পারে, তাই আমাদের সাবধান থাকতে হবে। এই চায়না জালের ব্যাপক বিস্তারের ফলে দেশে মাছের বংশবিস্তার বিঘ্নিত হওয়া ছাড়াও অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীন প্রাক্তন ক্যাপ্টেন ও চট্টগ্রাম পোর্টের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, চিন মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষতিকর অনেক পণ্য রফতানি করে। অসাধু আমদানিকারকরা যেভাবে বলবেন সেই নাম দিয়েই রফতানি করে তারা। তাই চায়না থেকে আমদানি করা প্রতিটি পণ্য খালাসের আগে কঠোর ভাবে পরীক্ষনিরীক্ষা করতে হবে। এই চায়না জাল তৈরির সুতো কী নামে আসে সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া জরুরি। ছোট ছোট প্রজাতির মাছ এবং মাছের রেণু পোনা মূলত নদী তীরের অগভীর জলেই থাকে। সেই জায়গায় এ রকম ভয়ানক জাল পাতা মানে পুরো মৎস্য সম্পদকে ঝুঁকির মুখে ফেলা।